বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (মধ্যযুগ)

একাদশ শ্রেণি

একাদশ শ্রেণির পাঠ্য ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ অংশটি যথেষ্ট তথ্যবহুল। শর্ট এবং এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মূল বইটি বেশ কয়েকবার পড়া উচিত। এখানে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের নির্যাসটুকু তুলে ধরা হল।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (মধ্যযুগ)

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য

বাংলা সহিত্যের মধ্যযুগের সময়কাল ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আনুমানিক ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে (অন্যমতে ১২০৬) বাংলাদেশ আক্রমণ করেন ইফতিকার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি। কথিত আছে যে, আকস্মিক এই আক্রমনের ফলে তৎকালীন রাজা লক্ষণ সেন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। এর ফল অত্যন্ত ভয়াবহ হয়েছিল। খিলজির নেতৃত্বে বাংলাদেশে নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। ধ্বংস হয় মন্দির, বৌদ্ধ বিহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার, নথিপত্র, প্রাচীন পুথি এবং পান্ডুলিপি। পরিস্থিতি এমনই ভয়ঙ্কর ছিল যে পরবর্তী দেড়শ বছর পর্যন্ত কোন সাহিত্য রচিতহয়নি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই দেড়শো বছর সময়কালকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগের শেষে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নমুনা হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের অধিবাসী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘরের মাচা থেকে একটি পুরাতন পুথি আবিষ্কার করেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভ। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে উক্ত পুথি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য নামে। কাব্যটি উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক। কাব্যের মূল চরিত্র তিনটি কৃষ্ণ, রাধা এবং বড়াই। সমগ্র কাব্য টি ১৩টি খন্ডে বিভক্ত। সেগুলি হল- জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখন্ড, ছত্রখন্ড, বৃন্দাবন খন্ড, কালিয়দমন খণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখন্ড, বাণখন্ড, বংশী খণ্ড ও রাধাবিরহ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটির একটি বিশেষ জায়গা রয়েছে কারণ দেড়শ বছর অন্ধকার যুগের পর এটিই প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন। পন্ডিতদের মতে, এটি হলো বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগের রচনা।

মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে অনেক প্রতিভাবান কবির সমাবেশ ঘটেছিল। তাদের লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য অনেকখানি সমৃদ্ধ হয়েছিল। দুয়েকটি ব্যতিক্রমী রচনা ছাড়া মধ্যযুগের বেশিরভাগ সাহিত্য ছিল দেবতা-কেন্দ্রিক। দেবতাদের স্তুতি বা দেবমাহত্ম্য প্রচার এবং দেবতার প্রতি নিঃশর্ত প্রেম-ভক্তিই ছিল এই সময়কার সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। যাইহোক, বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলি হল-

(১) অনুবাদ সাহিত্য

তুর্কি আক্রমনের ফলে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিত নড়ে গিয়েছিল। আঘাত এসেছিল প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার উপরেও। হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষজন সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থগুলির বাংলায় অনুবাদ শুরু করেন। অনুবাদ সাহিত্যের তালিকায় রয়েছে মূলতঃ

[ক] রামায়ণ অনুবাদ- বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য হল ‘রামায়ণ’। অনেক কবি এই সংস্কৃত মহাকাব্যের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তবে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কৃত্তিবাস ওঝা। কবি কৃত্তিবাস ওঝার কাব্যের নাম শ্রীরাম পাঁচালি।

[খ] মহাভারত অনুবাদ- মহর্ষি ব্যাসদেব রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর। তবে বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ কবি কাশিরাম দাস। তাঁর কাব্যের নাম ‘ভারত পাঁচালি’।

[গ] ভাগবত অনুবাদ- ভাগবত অনুবাদের ধারায় শ্রেষ্ঠ কবি মালাধর বসু। তাঁর কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।

(২) মঙ্গলকাব্য

লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক কাব্যই হল মঙ্গলকাব্য। বস্তুতপক্ষে, তুর্কি আক্রমণের ফলে বহুস্তরবিশিষ্ট হিন্দু সমাজের নিম্নস্তরে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল। রাজানুগ্রহ লাভের আশায় অথবা প্রাণনাশের ভয়ে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়ে যাচ্ছিল। এইরূপ অবস্থায়, সমাজের ভাঙ্গন প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে উচ্চবর্ণের মানুষদের উদ্যোগে সামাজিক মেলবন্ধনের চেষ্টা শুরু হয়। এই চেষ্টার ফল হিসেবেই লৌকিক দেবদেবীদের মাহাত্ম্যসূচক কাব্য লেখা শুরু হয়। প্রধান প্রধান মঙ্গলকাব্যগুলি হল মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি।

মঙ্গলকাব্যে ‘মঙ্গল’ কথাটি যুক্ত হলাে কেন? এ নিয়ে নানা মত দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য মতগুলি হল-

(ক) পরিবারের মঙ্গল কামনায় এইসব গানগুলি গাওয়া হতো।
(খ) মঙ্গলকাব্যগুলি মঙ্গল নামক রাগে গীত হতাে।
(গ) এই কাব্যগুলির গান এক মঙ্গলবারে শুরু হতাে এবং পরের মঙ্গলবারে শেষ হতাে।
(ঘ) মঙ্গল শব্দটি দ্রাবিড় শব্দ। এর অর্থ হলাে গমন বা যাওয়া, অর্থাৎ কোনাে স্থায়ী মঞ্চে মঙ্গলকাব্য গীত হতাে না। সাধারণত পাড়ায় পাড়ায় বা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গাওয়া হতাে।

ক) মনসামঙ্গল- মনসামঙ্গলের আদি কবি কানাহরি দত্ত। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবি হলেন বিজয় গুপ্ত, নারায়ণ দেব, বিপ্রদাস পিপলাই, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রমূখ।

খ) চন্ডীমঙ্গল- চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার আদি কবি মানিক দত্ত। অন্যান্য কবিদের তালিকায় রয়েছেন দ্বিজমাধব বা মাধবাচার্য, মুকুন্দ চক্রবর্তী প্রমুখ। তবে চন্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি অবশ্যই কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী।

গ) ধর্মমঙ্গল- ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার করা হতো। ধর্মঠাকুর ছিলেন নিম্নবর্ণের মানুষদের, বিশেষত ডোম সম্প্রদায়ের দেবতা। ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি ময়ূরভট্ট। তার কাব্যের নাম সূর্যশতক। অন্যান্য কবিদের মধ্যে রয়েছেন খেলারাম, রূপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী প্রমুখ।

ঘ) অন্নদামঙ্গল- অন্নদামঙ্গল কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর।

অন্যান্য অপ্রধান মঙ্গলকাব্যের মধ্যে রয়েছে কালিকামঙ্গল (বা বিদ্যসুন্দর), কৃষ্ণমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, রায়মঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, শিবমঙ্গল বা শিবায়ন প্রভৃতি।

(৩) বৈষ্ণব পদাবলি এবং জীবনিসাহিত্য

রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক গানই হল পদাবলি। আর পদাবলি রচনায় বাঙালি কবিদের অনুপ্রেরণা ছিলেন অপর এক বাঙালি কবি- জয়দেব। কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যটিকে বৈষ্ণব পদাবলির পূর্বসূরী বলা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে অসংখ্য কবি রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে অগণিত পদ রচনা করে গেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল।

(ক) বিদ্যাপতি– চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতিকে ‘মৈথিল কোকিল’ নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর কাব্যরচনায় কবি জয়দেবের প্রভাব থাকায় অনেকে তাঁকে ‘অভিনব জয়দেব’ বলে থাকেন। তিনি বিহারের অন্তর্গত দ্বারভাঙা জেলার বিসফি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সময়কাল আনুমানিক পঞ্চদশ শতক। তিনি রাজা শিবসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য রচনা করেছিলেন। পদাবলি ছাড়াও ‘পুরুষপরীক্ষা’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’ প্রভৃতি গ্রন্থও লিখেছিলেন।

(খ) চণ্ডীদাস– বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চন্ডীদাস নামক একাধিক কবির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, বড়ু চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস ইত্যাদি ভনিতায় অনেক পদ পাওয়া গেছে। তবে পদাবলির চণ্ডীদাস স্বীয় প্রতিভাগুণে অনন্য। তাঁর রচিত সহজ সুরে ভাব-গম্ভীর পদগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

(গ) জ্ঞানদাস– চৈতন্য পরবর্তী যুগের অন্যতম কবি ছিলেন জ্ঞানদাস। তাকে চন্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়।

(ঘ) গোবিন্দদাস– চৈতন্যোত্তর যুগের আরেকজন খ্যাতনামা কবি হলেন গোবিন্দদাস। তাঁকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ বলা হয়। বৈষ্ণব পদ ছাড়াও তিনিও ‘সংগীতমাধব’ নামক একটি নাটক এবং ‘কর্ণামৃত’ নামক একটি কাব্যও রচনা করেছিলেন।

জীবনীসাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ হল বৈষ্ণব জীবনীসাহিত্যগুলি। মুলত শ্রীচৈতন্যদেবের মহিমাময় জীবনকে কেন্দ্র করে বাংলা জীবনীসাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তবৃন্দ তাঁর জীবনী নিয়ে প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিলেন। মুরারি গুপ্তের লেখা ৭৮টি সর্গে বিভক্ত ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম’ এবং পরমানন্দ সেনের ‘চৈতন্যচরিতামৃতম’ গ্রন্থদুটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত চৈতন্যদেবের জীবনী গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্যজীবনীসাহিত্যের মধ্যে উল্লেখ্য হল- বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, লোচনদাস এবং জয়ানন্দের লেখা একই নামের দুটি গ্রন্থ ‘চৈতন্যমঙ্গল’, চুড়ামণি দাসের ‘গৌরাঙ্গবিজয়’ ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যে এই জীবনীসাহিত্যগুলির বিশেষ মূল্য রয়েছে। 

গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

আরাকান রাজসভার সাহিত্য

সুদূর আরাকান রাজসভাতেও বাংলা সাহিত্যের চর্চা হত। আরাকান রাজসভার কবি দৌলত কাজি এবং সৈয়দ আলাওল মধ্যযুগে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে গেছেন। দৌলত কাজী রচনা করেন ‘সতী ময়না’ বা ‘লোরচন্দ্রানী’। কাব্যটি হিন্দি কবি মিয়া সাধনের ‘মৈনা কা সত’ কাব্যের আদর্শে রচিত। কাব্যটি সমাপ্ত করার আগেই দৌলত কাজী পরলোকগমন করেন। কাব্যের অবশিষ্ট অংশ সমাপ্ত করেন আরাকান রাজসভার অপর শক্তিমান কবি সৈয়দ আলাওল। 

‘সতী ময়না’ বা ‘লোরচন্দ্রানী’ কাব্যটি সমাপ্ত করা ছাড়াও আলাওলের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘পদ্মাবতী’ এবং ‘সপ্তপয়কর’, ‘সিকান্দারনাম’, ‘তোহফা’, ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’  প্রভৃতি।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

বাংলা লোকসাহিত্য

লোকসংস্কৃতির প্রধানতম অঙ্গটি হলো লোককথা। যে সকল কথা (বা, কাহিনি) বহুযুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত আছে সেগুলিকে লোককথা বলে। লোক সমাজে প্রচলিত রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, ব্রতকথা, পুরাণকথা, জনশ্রুতি- এসবই লোককথার অন্তর্গত। বাংলা লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। প্রাচীন রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, ব্রতকথা, পুরাণকথা প্রভৃতি একসময় মানুষের সাহিত্য-পিপাসা নিবারণ করত, একইসঙ্গে সেগুলি সমাজশিক্ষকের ভূমিকা পালন করত।

আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

error: Content is protected !!