বাংলা লিপির ইতিহাস

একাদশ শ্রেণির বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের তৃতীয় অধ্যায় হল বাংলা লিপির ইতিহাস।

বাংলা লিপির ইতিহাস|| Bangla Lipir Itihas

প্রাচীন মিশরের লিপি

মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হল ভাষা। ভাষা অনেকরকমের হতে পারে তবে মৌখিক ভাষার সাহায্যে যতখানি মনের ভাব প্রকাশ করা যায় অন্য কোনো মাধ্যমে এতোখানি ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয়না। তবে মৌখিক ভাষা অর্থাৎ কথা তো কেবলই কথার কথা। কথা নশ্বর। কথাকে অবিনশ্বর করার জন্য মানুষ আবিষ্কার করেছিল লিপি। লিপির ইতিহাস খুবই প্রাচীন। কীভাবে মানুষ লিপি আবিষ্কার করল সেসব কথা আজ নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে আধুনিককালে বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে এবং প্রাচীনকালের নানা নমুনা দেখে লিপিবিশারদগণ লিপির ইতিহাস সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। এই অধ্যায়ে প্রাচীন বিশ্বের কয়েকটি লিপি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং সেই সুত্র ধরেই বাংলা লিপির উদ্ভবেতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

পন্ডিতদের মতে, মানুষ লিপির ব্যবহার শুরু করে শুরু করেছিল আনুমানিক পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে। সেই লিপি ছিল চিত্রলিপি অর্থাৎ ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করা হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে চিত্রলিপির নমুনা পাওয়া যায়। তবে চিত্রলিপির সমস্যা এটাই ছিল যে সব জিনিসের ছবি আঁকা সম্ভব নয়। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে মানুষ নতুন এক ধরনের লিপি আবিষ্কার করল। নতুন এই লিখন পদ্ধতির নাম ভাবলিপি অর্থাৎ একটি ছবিতে একটি মাত্র বস্তু বা প্রাণীকে না বুঝিয়ে একটি ভাবকে প্রকাশ করতে লাগলো। ক্রমে এই ভাবলিপি থেকে অক্ষরলিপি এবং তা থেকে আধুনিক ধ্বনিলিপির জন্ম হয়েছে।

কয়েকটি প্রাচীন লিপি

লিপিবিশারদগণ কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার নাম উল্লেখ করেছেন যেখানে লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সুমেরীয় সভ্যতা এবং মিশরীয় সভ্যতা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরাও লিপি ব্যবহার করতে জানতো। মায়া সভ্যতার লিপির কথাও জানা যায়। এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন স্থানে লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। যাইহোক, নীচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লিপির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল।

(১) সুমেরীয় লিপি– সুমেরীয় সভ্যতার লিপির নাম কিউনিফর্ম বা কীলকলিপি। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানুষ বিশ্বাস করতো যে ‘নেবো’ নামের দেবতা এই লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। নরম মাটিতে লিখে পর সেটিকে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হত। শুকনো চাকতি পেরেকের মতো খোঁচা খোঁচা হতো বলে এই লিপিকে কীলকলিপি বলা হয়।

(২) মিশরীয় লিপি- প্রাচীন মিশরের লিপির নাম হিয়েরোগ্লিফিক লিপি। ‘হিয়েরো’ কথার অর্থ পবিত্র, গ্লিফেইন’ কথার অর্থ খোদাই করা। হিয়েরোগ্লিফিক কথার অর্থ পবিত্র লিপি।

(৩) সিন্ধু লিপি– প্রাচীন বিশ্বের যে কয়টি অঞ্চলে লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছিল তাদের মধ্যে ভারতও একটি। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ লিপির ব্যবহার শিখেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সিন্ধুলিপি এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেইজন্য এই লিপি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

(৪) খরোষ্টী লিপি– খর বা গাধার ওষ্ঠের মতো চেহারা বলেই এই লিপির নাম খরোষ্ঠী লিপি। প্রাচীন ভারত এবং মধ্য এশিয়ার কিছু মুদ্রা, কাষ্ঠফলক এবং অশোকের কিছু শিলালিপিতে খরোষ্ঠী লিপির নমুনা পাওয়া যায়।

(৫) ব্রাহ্মী লিপি– ভারতের আধুনিক লিপিগুলির বেশিরভাগেরই জন্ম হয়েছে ব্রাহ্মী লিপি থেকে। অনেকের ধারণা ছিল ব্রাহ্মী লিপির আবিষ্কর্তা ব্রহ্মা। এই লিপির উদ্ভব সম্পর্কেও নানা মুনির নানা মত।

বাংলা লিপির উদ্ভব

অধিকাংশ লিপি বিশারদ মনে করেন খ্রি:পূ: সপ্তম-অষ্টম শতকে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব হয়েছিল। এই ব্রাহ্মীলিপি থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে কুষাণলিপির উদ্ভব হয়। কুষানলিপি থেকে আসে সিদ্ধমাতৃকা লিপি। সপ্তম শতকে সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকে জন্ম নেয় কুটিল লিপি। এই কুটিল লিপি থেকে অষ্টম শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি নতুন লিপিরূপ জন্ম নিল। যেমন, উত্তর-পশ্চিম ভারতের শারদা লিপি; মধ্য ভারত, রাজস্থান প্রভৃতি স্থানে নাগরীলিপি; পূর্ব ভারতে গৌড়ী লিপি বা প্রত্ন-বাংলা লিপি প্রভৃতি। এই হিসেবে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। তবে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মনে করেন সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। আবার সুকুমার সেন মনে করেন কুটিল লিপি থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। যাইহোক, বেশিরভাগ পন্ডিতের মত অনুসারে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে।

একাদশ শ্রেণির পাঠ্য বাংলা সাহিত্য ও ভাষার ইতিহাস বইটি পড়লে অনেকখানি সমৃদ্ধ হওয়া যাবে।

বাংলা লিপির ইতিহাসঃ অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

বাংলা লিপির ইতিহাস- এই অধ্যায় থেকে অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরের জন্য এই লিঙ্কে ক্লিক করো।

বাংলা লিপির ইতিহাসঃ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

পরের অধ্যায়ঃ বাংলা ভাষা এবং উপভাষা

error: Content is protected !!