শব্দ ও পদ

শব্দ ও পদ

একটি বা একাধিক ধ্বনি যদি কোনো অর্থ প্রকাশ করে তবে তাকে শব্দ হল। সহজ কথায় বললে, শব্দ হল অর্থ প্রকাশক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। শব্দ বাক্য গঠনের মূল উপাদান।

শব্দ বনাম পদ

শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হলে তাকে পদ বলে। শব্দ যুক্ত বিভক্তি সমান পদ। শব্দ এবং পদের মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে শব্দ সরাসরি বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে না, শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যোগ করলে সেটি পদ হয় এবং তখন সেটি বাক্যে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে। পদ সংক্রান্ত আলোচনা করার আগে শব্দ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার প্রয়োজন আছে।

শব্দের শ্রেণীবিন্যাস

শব্দকে জানতে হলে তার বিভিন্ন ভাগগুলি সম্পর্কে জানতে হবে। শব্দকে সাধারণত উৎস ,গঠন ও অর্থ অনুসারে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক শব্দের উৎপত্তি বা উৎসগত শ্রেণিবিভাগ।

শব্দের উৎসগত শ্রেণিবিভাগ

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলি কোনটি কোথা থেকে এসেছে- তার উপর ভিত্তি করে শব্দকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বাংলা শব্দভান্ডার অধ্যায়ে। এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

১. তৎসম শব্দ– বাংলায় প্রচলিত খাঁটি সংস্কৃত শব্দগুলিকে বলে তৎসম শব্দ। যেমন- পিতা, মাতা, গৃহ, বিদ্যালয় ইত্যাদি।

২. অর্ধ-তৎসম শব্দ– বাংলায় প্রচলিত বিকৃত বা ভাঙা সংস্কৃত শব্দগুলি অর্ধতৎসম শব্দ। যেমন- কেষ্ট, বোষ্টম, মোচ্ছব ইত্যাদি।

৩. তদ্ভব শব্দ– সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত, অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে যে শব্দগুলি বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে সেগুলি তদ্ভব শব্দ।

৪. দেশি শব্দ– আর্যরা এদেশে আসার আগে যারা এখানে বসবাস করত তাদের ভাষার যেসকল শব্দ বাংলায় প্রচলিত রয়েছে, সেগুলি দেশি শব্দ। যেমন- ঝিঙ্গা, ডিঙি ইত্যাদি।

৫. প্রাদেশিক শব্দ– ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ভাষা থেকে যেসকল শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে সেগুলি প্রাদেশিক শব্দ। যেমন- হরতাল (গুকরাটি), চুরুট (তামিল) ইত্যাদি।

৬. বিদেশি শব্দ– ভারতের বাইরে প্রচলিত ভাষা থেকে যেসকল শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারে স্থান পেয়েছে তাদেরকে বিদেশি শব্দ বলা হয়। ইংরেজি, আরবি, ফারসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি অনেক ভাষার শব্দ বাংলায় প্ৰচলিত আছে। যেমন- স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, স্টাডি, চেয়ার, বেঞ্চ ইত্যাদি।

৭. মিশ্র শব্দ– একটি ভাষা শব্দের সঙ্গে অপর একটি ভাষার শব্দ, প্রত্যয়, উপসর্গ ইত্যাদি যোগে যে শব্দ তৈরি হয়, তাকে মিশ্র শব্দ বলা হয়। যেমন- হেডপন্ডিত (ইংরেজি+সংস্কৃত)।

৮. নবাগত বা নবগঠিত শব্দ– যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক নতুন শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারে স্থান পেয়েছে। এইসব শব্দগুলিকে নবাগত বা নবগঠিত শব্দ বলা হয়। যেমন- ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টা, ট্রোল ইত্যাদি।

গঠন অনুসারে শ্রেণিবিভাগ

গঠন অনুসারে শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলি হল- ১) মৌলিক শব্দ ২) সাধিত শব্দ।

১. মৌলিক শব্দ– যে শব্দকে বিশ্লেষণ করা যায় না এবং জোরপূর্বক বিশ্লেষণ করলেও কোনো অর্থপ্রকাশক শব্দ পাওয়া যায় না তাকে তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন- মা, বাবা, ভাই, বই, ঘর ইত্যাদি।

২. সাধিত শব্দ– সাধিত কথাটির অর্থ সম্পাদিত। ধাতু বা শব্দের সঙ্গে প্রত্যয়, উপসর্গ বা অনুষঙ্গ যোগ করে অথবা দুটি স্বাধীন শব্দ সমাসবদ্ধ হয়ে যে নতুন শব্দ তৈরি করে তাদেরকে সাধিত শব্দ বলে। সাধিত শব্দকে বিশ্লেষণ করলে এক বা একাধিক মৌলিক শব্দ পাওয়া যায়। সাধিত শব্দ হল এইগুলি-

ক) প্রত্যয়-নিষ্পন্ন শব্দ– শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে প্রত্যয় নিষ্পন্ন শব্দ তৈরি হয় প্রকৃতি-প্রত্যয় অধ্যায়ে এবিষয়ে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- পঠ্+ণক = পাঠক, হস্ত+ইন = হস্তী ইত্যাদি।

খ) সমাসজাত শব্দ– পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুই বা তার বেশি পদের মিলনকে বলা হয় সমাস। যেমন- রাজার পুত্র= রাজপুত্র, বীণা পাণিতে যার= বীণাপাণি ইত্যাদি। সমাস অধ্যায়ে এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

গ) উপসর্গযুক্ত শব্দ– ধাতুর পূর্বে উপসর্গ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠিত হয়। যেমন- প্ৰ+ শান্ত= প্রশান্ত, প্ৰ+ বেশ = প্রবেশ ইত্যাদি।

ঘ) অনুষঙ্গ নিষ্পন্ন শব্দ– অনুষঙ্গ শব্দটি প্রসঙ্গ, সাহচর্য, সংযোগ ইত্যাদি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে নতুন শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে অনুষঙ্গ বলতে বোঝায় প্রাসঙ্গিক ভাব। একটি মূল শব্দের ভাবকে অনুসরণ করে আরেকটি শব্দ এসে যুক্ত হলে যে শব্দটি তৈরি হয় তাকে অনুষঙ্গ নিষ্পন্ন শব্দ বলা যেতে পারে। অনুষঙ্গ নিষ্পন্ন শব্দ তিন রকমের হয়। যথাঃ

ক) শব্দদ্বৈত– একই শব্দ পরপর দুবার ব্যবহৃত হয় কোন বিশেষ ভাব প্রকাশ করলে তাকে শব্দদ্বৈত বলা হয়। যেমন-
কেমন গরমগরম পেলে?
দিনদিন স্কুল কামাই করা ভালো নয়।
বস্তাবস্তা চাল দেওয়া হচ্ছে।
মনে মনে কলা খেও না।

খ) অনুকার শব্দ– একটি শব্দের অনুকরণে বা বিকারে যখন আরেকটি শব্দ এসে যুক্ত হয়, তখন তাকে অনুকার শব্দ বলা হয়। যেমন, জড়-সড়, খাবার-দাবার, মুড়ি-টুড়ি, ভাত-টাত, জল-টল ইত্যাদি।

গ) ধ্বন্যাত্মক শব্দ– বাস্তব ধ্বনির অনুকরণে সৃষ্ট শ্রুতিগ্রাহ্য বা অনুভূতিযোগ্য শব্দকে বলা হয় ধ্বন্যাত্মক শব্দ। যেমন- বেশি কথা বলা অর্থে বকবক, কুকুরের ডাক বোঝাতে ‘ঘেউঘেউ’ শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়। এগুলি সব ধ্বন্যাত্মক শব্দের উদাহরণ।

অর্থমূলক শ্রেণিবিভাগ

অর্থই শব্দের প্রাণ। সেজন্য শব্দের শ্রেণিকরণে অর্থের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রে শব্দের গঠন বিচার্য নয়, অর্থের প্রেক্ষাপটই প্রধান বিবেচ্য। প্রত্যয়নিষ্পন্ন শব্দ হোক বা সমাসবদ্ধ পদ হোক- অর্থ অনুসারে বাংলা শব্দগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলি হল-

১. যৌগিক শব্দ– যেসব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও প্রচলিত অর্থ একই, তাদেরকে যৌগিক শব্দ বলা হয়। অন্যভাবে বললে, যেসব শব্দের প্রচলিত অর্থ তার মূল অর্থকে অনুসরণ করে, তাদেরকে যৌগিক শব্দ বলা হয়। যেমন-

পঠ্+ ণক= পাঠক- এটি প্রত্যয় নিষ্পন্ন শব্দ। এর অর্থ পাঠ করে যে এবং এই অর্থেই প্রচলিত। অর্থাৎ, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যা প্রচলিত অর্থও তাই। এবার একটি সমাসবদ্ধ শব্দের উদাহরণ দেওয়া যাক-

রাজপুত্র= রাজার পুত্র। এখানেও শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ যা, প্রচলিত অর্থও সেটাই। এগুলি যৌগিক শব্দ।

২. রূঢ়ি শব্দ– যে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ আলাদা হয়, তাদেরকে রূঢ়ি শব্দ বলে। যেমন-

হস্তী (হস্ত+ইন) শব্দটি প্রত্যয়জাত শব্দ এবং এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হস্ত বা হাত আছে যার। কিন্তু প্রচলিত অর্থে হস্তী বলতে একটি বিশেষ প্রাণীকে (হাতিকে) বোঝায়। এবার একটি সমাসবদ্ধ পদের উদাহরণ দেওয়া যাক-

মহাজন শব্দটির প্রকৃত অর্থ মহান যে জন বা মহৎ মানুষ। কিন্তু প্রচলিত অর্থে মহাজন বলতে বোঝায় উত্তমর্ণ বা কুসীদজীবী বা সুদখোর ব্যক্তি।

৩. যোগরূঢ় শব্দ– যেসব শব্দের প্রচলিত অর্থ এবং ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একেবারে আলাদা নয় আবার সম্পূর্ণ একও নয়, বরং ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে প্রচলিত শব্দের একটি যোগ থাকে, সেই শব্দকে যোগরূঢ় শব্দ বলা হয়। অন্যভাবে বললে, যেসব রূঢ়ি শব্দের ব্যবহারিক অর্থের সঙ্গে ব্যুৎপত্তিগত অর্থের একটি যোগ (সম্পর্ক) থাকে, তাদেরকে যোগরূঢ়ি শব্দ বলা হয়। যেমন-

পঙ্কজ (পঙ্ক-√জন+ড) শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পঙ্কে বা পাঁকে জন্মে যা। কিন্তু প্রচলিত অর্থে পঙ্কজ বলতে পদ্মকে বোঝায়। পদ্ম যেমন পাঁকে জন্মায় তেমনি আরো অনেক কিছু পাঁকে জন্মায়, কিন্তু কেবল পদ্মকে পঙ্কজ বলা হয়। এইভাবে, ব্যুৎপত্তিগত অর্থের হুবুহু অনুসরণ না করে আংশিক অনুসরণ করা হল। এটাই যোগরূঢ়ি শব্দ।

জোড়কলম ও লোকনিরুক্তি

শব্দ বিষয়ক আলোচনায় আরো দুটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। একটি হল জোড়কলম শব্দ, আরেকটি হল লোকনিরুক্তি। এগুলি শব্দের প্রকার বিশেষ। অনেকেই এগুলিকে শব্দের উৎসগত শ্রেণিতে ধরেন, আবার অনেকে গঠনগত বা অর্থগত শ্রেণিতে আলোচনা করেন। আমরা এই শব্দগুলিকে কোনো বিশেষ শ্রেণিভুক্ত না করে এই দুই প্রকার শব্দ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

জোড়কলম শব্দ

দুই বা তার বেশি শব্দের খণ্ডিত অংশ জুড়ে দিয়ে নতুন যে শব্দটি পাওয়া যায় তাকে জোড়কলম শব্দ বলে। যেমন- ধোঁয়া এবং কুয়াশা মিলে ধোঁয়াশা শব্দটি এসেছে।

লোকনিরুক্তি

কোনো অপরিচিত শব্দ লোকমুখে প্রচলিত হয়ে অল্পবিস্তর ধ্বনিসাম্যের ফলে যদি পরিচিত শব্দরূপ লাভ করে এবং এই প্রক্রিয়ায় উক্ত মূল শব্দের উচ্চারণ এবং অর্থ বিকৃতি ঘটে, তবে নবজাত শব্দটিকে বলা হয় লোকনিরুক্তি। যেমন- Arm Chair থেকে আরাম কেদারা শব্দটি এসেছে।

পদপরিচয়

আগেই বলা হয়েছে শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে পদে পরিণত হয়। এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে, শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যোগ করার প্রয়োজন হয় কেন? কারণ, শব্দকে বাক্যে ব্যবহার করতে গেলে শব্দের সঙ্গে বিভক্তি জুড়ে দিয়ে, সেটিকে পদে পরিণত করে, তবেই বাক্যে ব্যবহার করা যায়। এটাই ব্যাকরণের নিয়ম। ব্যাকরণ যেহেতু ভাষা বিষয়ক আলোচনা, তাই ব্যাকরণে পদের আলোচনাই বেশি। যাইহোক, দেখে নেওয়া যাক পদ কত রকমের হয়। পরের অধ্যগুলিতে প্রতিটি পদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

পদ বৈশিষ্ট্য 
বিশেষ্য কোনো কিছুর নাম বোঝায়।
সর্বনাম বিশেষ্য পদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়।
বিশেষণ  বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের দোষ, গুণ, অবস্থা বোঝায়।
ক্রিয়া কোনো কিছু করা, হওয়া বা থাকা বোঝায়।
অব্যয় পুরুষ এবং ক্রিয়ার কালভেদে যে পদের ব্যয় বা ক্ষয় নেই।

কারক-বিভক্তি সূচিপত্র বিশেষ্য পদ

error: Content is protected !!