কারক বিভক্তি অনুসর্গ

কারক বিভক্তি অনুসর্গ

শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে শব্দগুলি বাক্যে ব্যবহৃত হয়। বাক্যে ব্যবহৃত শব্দগুলিকে পদ বলা হয়। পদ নানা প্রকারের হয়। যেমন- নামপদ, ক্রিয়াপদ ইত্যাদি। বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের সম্পর্ককে বলা হয় কারক। কারক আলোচনার আগে বিভক্তি-অনুসর্গ সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার।

কারক-অকারক পদ- বিভক্তি-অনুসর্গ-নির্দেশক

বিভক্তি কাকে বলে?

যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি (অথবা, বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি) শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দকে পদে পরিণত করে তাকে বিভক্তি বলে।

বিভক্তি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল বিভাজন। কিন্তু ব্যাকরণে বিভক্তি বোঝায় সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে যা শব্দকে বাক্যে ব্যবহারের উপযোগি করে তুলে। [শব্দ+বিভক্তি=পদ] বিভক্তি মূলতঃ দুই প্রকার-

১) শব্দ বিভক্তি

যে বিভক্তি শব্দকে পদে (নামপদে) পরিণত করে তাকে শব্দ বিভক্তি বলে। যেমন- এ, কে, রে, তে, য়, র, এর এবং শূন্য বিভক্তি। উদাহরণ-

• এ বিভক্তি- পাগলে সবই বলে।
• কে বিভক্তি- ভুতকে ভয় পেয়ো না।
• রে বিভক্তি- দেবতারে প্রণাম করিও।
• তে বিভক্তি- তিনি কলকাতাতে থাকেন।
• য় বিভক্তি- কলকাতায় সব পাওয়া যায়।
• র বিভক্তি- বাবার যোগ্য ছেলে।
• এর বিভক্তি- বাপের ব্যাটা।
• শূন্য বিভক্তি- যেমন বাবা তেমন ছেলে

শূন্য বিভক্তি কাকে বলে?

ব্যাকরণের নিয়ম হল, শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হলে তবেই শব্দ পদে পরিণত হয় এবং বাক্যে ব্যবহারের উপযোগি হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি কোনো পদের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে কোনো বিভক্তি যুক্ত থাকে না তবে ব্যাকরণের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় যে একটি বিভক্তি যুক্ত আছে। এই বিভক্তিকে বলা হয় শূন্য বিভক্তি বলে।

২) ক্রিয়া বিভক্তি

ধাতুর সঙ্গে যে বিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ গঠন করে তাকে ক্রিয়া বিভক্তি বলে। যেমন- ছি, ছে, ছেন ইত্যাদি। নিচে ‘পড়্’ ধাতুর সঙ্গে বিভিন্ন ক্রিয়াবিভক্তি যোগ করে উৎপন্ন ক্রিয়াপদগুলি বাক্যে প্রয়োগ করা হল। চলিত রূপের পাশে বিভক্তিগুলির সাধুরূপও দেওয়া হল।

ছেলেটি বই পড়ে। (পড়্+এ)
ছেলেটি বই পড়ছে। (পড়্+ছে/ইতেছে)
ছেলেটি বই পড়েছে।(পড়্+ এছে/ইয়াছে)
ছেলেটি বই পড়ল। (পড়্+ল/ইল)
ছেলেটি বই পড়েছিল। (পড়্+এছিল/ইয়াছিল)
ছেলেটি বই পড়ছিল। (পড়্+ছিল/ইতেছিল)
ছেলেটি বই পড়বে। (পড়্+বে/ইবে)
ছেলেটি বই পড়তে থাকবে।(পড়্+তে/ইতে)

[উল্লেখ্য যে, ক্রিয়া বিভক্তিগুলি ক্রিয়ার কাল, প্রকার, বাচ্যকে নির্দেশ করে। ক্ষেত্রবিশেষে, কর্তার পুরুষ বা পক্ষকেও নির্দেশ করে থাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।]

অনেক পড়াশোনা করতাম“- এই বাক্যের ক্রিয়াপদ ‘করতাম’ = √কর্ (ধাতু) + তাম (ক্রিয়াবিভক্তি)। এবার দেখা যাক করতাম বলতে কী কী বোঝা গেল।

১) ক্রিয়ার কাল= নিত্যবৃত্ত অতীত কাল
২) ক্রিয়ার প্রকার= নিত্যবৃত্ত
৩) বাচ্য= কর্তৃবাচ্য (ভাববাচ্য বা কর্মবাচ্য হলে ‘করা হত’ ক্রিয়াপদ হত।
৪) পুরুষ/ পক্ষ= উত্তম পুরুষ বা আমি পক্ষ (কারণ, মধ্যম পুরুষ বা তুমি পক্ষ হলে ক্রিয়াপদটি হত করতে/ করতেন/ করতিস। প্রথম পুরুষ বা সে পক্ষ হলে ক্রিয়াপদ হত করত/ করতেন)

অনুসর্গ

যে সকল শব্দ কোনো শব্দের পরে বসে শব্দ বিভক্তির কাজ করে, তাদেরকে অনুসর্গ বলা হয়। অনুসর্গের অপর নাম পরসর্গ

অনুসর্গ মূলত দু’রকম-
১) শব্দজাত অনুসর্গ- দ্বারা, জন্য, নিমিত্ত ইত্যাদি।
২) ক্রিয়াজাত অনুসর্গ- হইতে, থেকে, চেয়ে, লাগিয়া ইত্যাদি।

অনুসর্গের বাক্যে প্রয়োগ
১. সবার দ্বারা সব কাজ হয় না।
২. সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু।
৩. মানুষ মানুষের জন্য
৪. দূর থেকে দেখেছিলাম তারে।
৫. তার চেয়ে সুন্দর তুমি।

বিভক্তি বনাম অনুসর্গ

প্রথমত, বিভক্তি শব্দকে পদে পরিণত করে। কিন্তু, অনুসর্গ শব্দকে পদে পরিণত করতে পারে না। বিভক্তিযুক্ত শব্দের পরেই অনুসর্গ বসে।
দ্বিতীয়ত, বিভক্তি হল বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি। পক্ষান্তরে, অনুসর্গ নিজেই একটি পদ (অব্যয়পদ)।
তৃতীয়ত, বিভক্তি শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, অর্থাৎ, শব্দের সঙ্গে মিশে যায়। অপরপক্ষে, অনুসর্গ শব্দের পরে পৃথকভাবে বসে।
চতুর্থত, বিভক্তি সাধারণত অর্থহীন। অপরপক্ষে, প্রতিটি অনুসর্গের নিজস্ব অর্থ আছে।

নির্দেশক

যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি (লেখ্যরূপে, বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি) নামপদের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং নামপদটির বচন নির্দেশ করে তাকে নির্দেশক বলে। যেমন-

একবচনের নির্দেশক– টি, টা, টো, টে।
বহুবচনের নির্দেশক– গুলি, গুলো (এবং গুলান, গুলা ইত্যাদি আঞ্চলিক রূপ)।

কারক ও অকারক পদ

কারক কাকে বলে?

কারক শব্দটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করলে পাওয়া যায় ‘√কৃ+ণক’ অর্থাৎ, ক্রিয়া সম্পাদন করে যে। সংস্কৃত ব্যাকরণে কারক সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘ক্রিয়ান্বয়ী কারকম্’, অর্থাৎ, ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কই হল কারক। বাংলা ব্যাকরণে কারকের ধারণাটি এসেছে সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে। একসময় বাংলা কারক-বিভক্তি নির্ণয় করা হত সংস্কৃত ব্যাকরণকে অনুসরণ করে। এখন বাংলা কারক-বিভক্তির বিষয়টি সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। যাইহোক, কারকের সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে- বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে অন্যান্য পদের সম্পর্ককে বলা হয় কারক। কারক হল পদের অন্বয়গত পরিচয়।

কারকের শ্রেণিবিভাগ

বাক্যে ক্রিয়াপদের সঙ্গে অন্যান্য পদের সম্পর্ক ছয় রকমের হতে পারে। সেইজন্য কারকও ছয় প্রকার। ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে কারকগুলি হল এইরকম-

(১) কর্তৃ কারক- যে ক্রিয়া সম্পন্ন করে
(২) কর্ম কারক- যাকে অবলম্বন করে কর্তা ক্রিয়া সম্পন্ন করে
(৩) করণ কারক- যার সাহায্যে কর্তা ক্রিয়া সম্পন্ন করে
(৪) নিমিত্ত কারক- যার জন্য ক্রিয়া সম্পন্ন হয়
(৫) অপাদান কারক- যেখান থেকে/যখন থেকে ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়
(৬) অধিকরণ কারক- যখন/ যেখানে/ যেভাবে/ যে বিষয়ে ক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

কারকের শ্রেণিবিভাগ (সবিস্তারে)

আগের আলোচনাটি ছিল শুধুমাত্র বোঝার জন্য। এরপর দেখে নেওয়া যাক বাংলা ব্যাকরণে কারকের বিস্তারিত শ্রেণি বিভাগ।

(১) কর্তৃকারক

বাক্যে যে পদটি ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে বলা হয় কর্তা। ক্রিয়াপদের সঙ্গে সেই পদের সম্পর্ককে বলা হয় কর্তৃকারক। নিচে বিভিন্ন প্রকার কর্তৃকারকের সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দেওয়া হল।

(ক) প্রযোজক কর্তা- যখন কর্তা নিজে না কাজ করে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করায়, তখন তাকে বলে প্রযোজক কর্তা। যেমন-

১. মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছে।
২. কোচ খেলোয়াড়দের খেলাচ্ছেন।
৩. মাস্টারমশাই ছেলেদের পড়াচ্ছেন।

উপরের তিনটি উদাহরণে প্রযোজক কর্তাগুলি হল যথাক্রমে- মা, কোচ এবং মাস্টারমশাই। এরা প্রত্যেকেই প্রযোজক, অর্থাৎ, এরা কাউকে দিয়ে কিছু কাজ করাচ্ছেন।

(খ) প্রযোজ্য কর্তা- প্রযোজক কর্তা যাকে দিয়ে কাজটি করায় সে হল প্রযোজ্য কর্তা। উপরের তিনটি উদাহরণে প্রযোজ্য কর্তাগুলি হল শিশু, খেলোয়াড় এবং ‘ছেলেরা। এরা কিছু কাজ করছে তাই এরা কর্তা। একইসঙ্গে বলা যায়, এরা যে কাজ করছে সেটি অন্যের প্রযোজনায়। সেইজন্য এরা প্রযোজ্য কর্তা।

[ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করা প্রয়োজন। মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন। মা কর্তা। মায়ের কাজ হল পথপ্রদর্শকের (গাইডের) মতো। মা মুখে উচ্চারণ করে, আঙ্গুল দিয়ে দিকনির্দেশ করে চাঁদ দেখাচ্ছেন। কিন্তু শিশুটি কার চোখ দিয়ে চাঁদকে দেখছে? অবশ্যই তার নিজের চোখ দিয়ে। তার মানে, চাঁদ দেখার কাজটি শিশুটিই করছে। এইজন্য সেও কর্তা। যেহেতু অন্যের প্রযোজনায় সে কাজটি করছে তাই সে প্রযোজ্য কর্তা।]

(গ) অনুক্ত কর্তা- যে বাক্যের কর্তা প্রধানভাবে প্রতীয়মান হয় না তাকে অনুক্ত কর্তা বলে। সাধারণত ভাব বাচ্যের কর্তাকে অনুক্ত কর্তা বলা হয়। যেমন-
১. আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
২. তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না।
৩. মহাশয়ের আসা উচিত হয় নাই।

(ঘ) সমধাতুজ কর্তা- বাক্যের কর্তা এবং ক্রিয়াপদ একই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হলে সেই কর্তাকে সমধাতুজ কর্তা বলে। যেমন-
১. লেখক লিখতে বসেছেন।
২. খেলোয়াড়রা মাঠে খেলছে।
৩. রাঁধুনি রান্না করছে।

(ঙ) নিরপেক্ষ কর্তা- বাক্যে সমাপিকা ক্রিয়া এবং অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা ভিন্ন ভিন্ন হলে অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তাটিকে নিরপেক্ষ কর্তা বলে। যেমন-
১. সে গান গাইলে ছেলেরা নাচবে।
২. তুমি চুপ করলে আমি দুয়েক কথা বলবো।
৩. পাখিরা বাসায় ফিরে এলে ছেলেরা পড়তে বসবে।

(চ) ব্যতিহার কর্তা- দুই বা তার বেশি কর্তা পারস্পরিক সাহচর্যে ক্রিয়া সম্পাদন করলে তাদেরকে ব্যতিহার কর্তা বলে। যেমন-
১. রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়।
২. ঝি-চাকরে বাড়ির সব কাজ করে দেয়।
৩. মানুষে মানুষে কেন মারামারি করে?

(ছ) উহ্য কর্তা- কোনো বাক্যে কর্তা উহ্য থাকলে সেই কর্তাকে উহ্য কর্তা বলে। যেমন-
১. পড়তে বোসো। (তুমি উহ্য)
২. এদিকে আই। (তুই উহ্য)
৩. ভিতরে আসুন। (আপনি উহ্য)
৪. চলে গেল। (প্রথম পুরুষ উহ্য)
৫. একটু পরেই ফিরে আসছি।(উত্তম পুরুষ উহ্য)

(ঝ) কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা- বাক্যের কর্ম যখন কর্তা হিসেবে প্রতীয়মান হয় তখন সেই কর্তাকে কর্মকর্তৃবাচ্যের করতে বলা হয়। যেমন-
১. আকাশে ঘুড়ি উড়ছে।
২. সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে।
৩. গ্রামে তখন শাঁখ বাজে।

(২) কর্মকারক

বাক্যের কর্তা যাকে আশ্রয় করে বা অবলম্বন করে ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে বলা হয় কর্ম এবং ক্রিয়াপদের সঙ্গে উক্ত কর্মের সম্পর্ককে বলা হয় কর্মকারক। নিচে বিভিন্ন প্রকার কর্মকারকের সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দেওয়া হল।

(ক) মুখ্য কর্ম- বস্তুবাচক কর্মকে বলা হয় মুখ্য কর্ম। যেমন-
১. সে বই পড়ছে।
২. লোকগুলি ভাত খাচ্ছে।
৩. ছেলেরা ফুল এনেছে।

(খ) গৌণ কর্ম- প্রাণিবাচক কর্মকে বলা হয় গৌণ কর্ম।
১. সে আমাকে ডাকলো।
২. তুমি রামকে নিয়ে যাও।
৩. আজ রহিমকে আসতে বলব।

(গ) সমধাতুজ কর্ম- বাক্যের ক্রিয়া এবং কর্ম একই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হলে কর্মটিকে বলা হয় সমধাতুজ কর্ম। যেমন-

১. কী খেলাই খেললো!
২. তোমার খুব বাড় বেড়েছে।
৩. আজ খুব ভালো রাঁধনা রেঁধেছ।

(ঘ) উদেশ্য ও বিধেয় কর্ম- যদি একটি বাক্যে দুটি কর্ম থাকে এবং উভয়ে একই ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়কে ইঙ্গিত করে তবে তাদের মধ্যে প্রধান বা প্রথমটিকে উদ্দেশ্য কর্ম এবং অপ্রধান বা দ্বিতীয় কর্মটিকে বিধেয় কর্ম বলে। যেমন-

১. অনেকেই অর্থকে পরমার্থ মনে করে।
২. জ্ঞানী মানুষ কর্মকে ধর্ম বলে মনে করেন।
৩. আমরা অতিথিকে দেবতা বলে মনে করি।

প্রথম বাক্যে দুটি কর্ম- ‘অর্থকে’ এবং ‘পরমার্থ’। ‘অর্থকে’ উদ্দেশ্য কর্ম এবং ‘পরমার্থ’ বিধেয় কর্ম। দ্বিতীয় বাক্যে, ‘কর্মকে’ উদ্দেশ্য কর্ম এবং ‘ধর্ম’ বিধেয় কর্ম। তৃতীয় বাক্যে ‘অতিথিকে’ উদ্দেশ্য কর্ম এবং ‘দেবতা’ বিধেয় কর্ম।

(ঙ) অক্ষুণ্ন কর্ম- সাধারণত মুখ্য কর্মকে (অর্থাৎ, অপ্রাণিবাচক বা বস্তুবাচক কর্মকে) বলা হয় অক্ষুন্ন কর্ম। কারণ, বাচ্য পরিবর্তন করার পরেও মুখ্য কর্মটি অক্ষুন্ন অবস্থায় থাকে। যেমন-

– সে বই পড়ছে (কর্তৃবাচ্য)
– তার দ্বারা বই পঠিত হচ্ছে। (কর্মবাচ্য)
উপরের উদাহরণে ‘বই’ হল অক্ষুণ্ন কর্ম। বাচ্য পরিবর্তন করার পরেও কর্মটির কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি।

(চ) কর্মের বীপ্সা- বাক্যে কর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাকে বলা হয় কর্মের বীপ্সা। যেমন-

১. লোকটা তখন থেকে ভাত ভাত করছে।
২. সকাল থেকে ছেলেটাকে পড় পড় করছে।

(৩) করণকারক

কর্তা যার দ্বারা বা যার সাহায্যে ক্রিয়া সম্পাদন করে, তাকে করণ বলে। করণ বাচক পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের যে সম্পর্ক তাকেই করণ কারক বলে। নিচে বিভিন্ন প্রকার করণকারকের সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দেওয়া হল।

(ক) উপলক্ষণ বা লক্ষণাত্মক করণ- যে করণ বাচক পদটি কোনাে লক্ষণ বা চিহ্ন হিসেবে প্রযুক্ত হয় তাকে লক্ষণাত্মক করণ বলে। যেমন-
১. কলমে কায়স্থ চিনি, গোঁফেতে রাজপুত।
২. চোখে মানুষের মন বোঝা যায়।
৩. পোশাকে ভদ্রলোক চেনা যায়।

(খ) কালাত্মক করণ- কাল বা সময়ের সঙ্গে বাক্যের ক্রিয়াপদের করণ সম্পর্ক স্থাপিত হলে উক্ত করণ বাচক পদকে কালাত্মক করণ বলা হয়। যেমন-
১. সরকারি অফিসে আঠারো মাসে বছর হয়।
২. সাত দিনে এক সপ্তাহ হয়।
৩. তিরিশ দিনে এক মাস হয়।

(গ) হেতুবাচক করণ- করণ বাচক পদটি যদি ক্রিয়াপদের কারণ বা হেতু হিসেবে প্রতিপন্ন হয় তবে তাকে হেতুবাচক বা হেত্বর্থক করণ বলে। যেমন-
১. লোকটা ঋণে জর্জরিত।
২. দাদু শোকে শয্যাশায়ী হয়ে গেছে।
৩. আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম।

(ঘ) যন্ত্রাত্মক করণ- করণ বাচক পদটি যদি হয় ক্রিয়া সম্পাদনের যন্ত্র, তবে উক্ত করণকে যন্ত্রাত্মক করণ বলা হয়। যেমন-
১. এই কলমে লেখা যায়না।
২. তুমি চশমা দিয়ে দেখো।
৩. ছেলেটি লাঠি দিয়ে গরু-মোষ তাড়াচ্ছে।

(ঙ) সমধাতুজ করণ- যদি কোনো বাক্যের করণ বাচক পদ এবং ক্রিয়াপদ একই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয় তখন তাকে সমধাতুজ করণ বলে। যেমন-
১. যে বাঁধনে বেঁধেছ।
২. লেখনি দিয়ে লেখা হয়।
৩. লোকটি কাটারি দিয়ে এক বোঝা কাঠ কাটল।

(৪) নিমিত্ত কারক

কর্তা যার নিমিত্তে বা যার জন্য ক্রিয়া সম্পাদন করে তাকে নিমিত্ত বলে। নিমিত্ত বাচক পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের যে কারক হয় তাকে নিমিত্ত কারক বলে। আগে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করে এই প্রকার কারককে বলা হতো সম্প্রদান কারক। বর্তমানে আর সম্প্রদান নয়, নিমিত্ত কারক। যেমন-
১. সে তার বাবার জন্য বিলাতি বস্ত্র এনেছিল।
২. পূজার জন্য ফুল তুলো।
৩. ছেলেটি ভাইয়ের জন্য খেলনা কিনছে।

(৫) অপাদান কারক

যেখান থেকে ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয় তাকে অপদান বলে। অপদানবাচক পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সম্পর্ককে বলে অপদান কারক বলা হয়। নিচে বিভিন্ন প্রকার অপাদান কারকের উদাহরণ দেওয়া হল।

(ক) স্থানবাচক- লোকটি ছাদ থেকে পড়ে গেল।
(খ) কালবাচক- বিকেল থেকে বৃষ্টি পড়ছে।
(গ) দুরত্ববাচক- কলকাতা থেকে দিল্লি বহু দূর।
(ঘ) হেতুবাচক- পরীক্ষার ভয়ে জ্বর এসেছে।
(ঙ) উৎসবাচক- আখের রসে গুড় হয়।

(৬) অধিকরণ কারক

ক্রিয়ার আধার বা আশ্রয়কে বলা হয় অধিকরণ। বাক্যে অধিকরণ বাচক পদটির সঙ্গে ক্রিয়াপদের যে সম্পর্ক তাকে বলা হয় অধিকরণ কারক। নিচে বিভিন্ন প্রকার অধিকরণ কারকের সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দেওয়া হল।

(ক) স্থানাধিকরণ- স্থান বোঝাতে যে অধিকরণ হয় তাকে স্থানাধিকরণ বলে। যেমন-
১. সে কলকাতায় থাকে।
২. কথাটা কোনো বইয়ে পড়েছি।
৩. মৌচাকে থাকে মধু।

(খ) কালাধিকরণ- কাল বা সময় বোঝাতে যে অধিকরণ হয় তাকে কালাধিকরণ বলে। যেমন-
১. সে বিকেলে ফিরবে।
২. গ্রীষ্মে হাতপাখা লাগবে।
৩. আমরা রাতে বেড়াতে যাবো।

(গ) ভাবাধিকরণ- ভাব বোঝাতে যে অধিকরণ হয় তাকে ভাবাধিকরণ বলে। যেমন-
১. লোকটি তাড়াতাড়ি হাঁটছে।
২. ছেলেটা আনমনে সাইকেল চালাচ্ছে।
৩. সে আস্তে কথা বলে।

(ঘ) বিষয়াধিকরণ- বিষয় বোঝাতে যে অধিকরণ হয় তাকে বিষয়াধিকরণ বলে। যেমন-
১. বিনয় অংকে কাঁচা।
২. আমাদের স্যার ইংরেজিতে পন্ডিত।
৩. সে পর্বতারোহণে পটু।

অকারক পদ

বাক্যে এমন কিছু পদ থাকে যাদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সরাসরি সম্পর্ক থাকে না। ক্রিয়াপদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক নেই এমন পদগুলিকে বলা হয় অকারক পদ। অকারক পদ দুই প্রকার-

(ক) সম্বন্ধ পদ– যে পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকে না বরং অন্য কোনো নামপদের সম্পর্ক থাকে তাকে সম্বন্ধ পদ বলে। ক্রিয়াপদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক থাকে না বলে একে অকারক পদ হিসেবে গণ্য করা হয়।

যেমন- “ছেলেটি মামার বাড়ি যাবে”- এই বাক্যে ‘যাবে’ হল ক্রিয়াপদ, ‘ছেলেটি’ হল কর্তৃকারক (কারণ ছেলেটি যাবে), ‘মামার বাড়ি’ হল অধিকরণ কারক (কোথায় যাবে? উত্তর- মামার বাড়ি)। কিন্তু ‘মামার বাড়ি’ এই পদদুটির মধ্যে ‘মামার’ পদটির সঙ্গে কেবল ‘বাড়ি’ পদটির সম্পর্ক রয়েছে, ‘যাবে’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। যদি বলি, “ছেলেটি মামার যাবে”- কথাটার কোনো মানে হয় না। ‘মামার’ পদটি হল সম্বন্ধ পদ।

অন্যান্য উদাহরণ
১) গরুর দুধ খুব পুষ্টিকর।
২) গ্রামের যোগী ভিক্ষা পায় না।
৩) রাজার ছেলে রাজা হয় না।
৪) আমি বাবার ঘড়িটা পড়েছি।
৫) বাড়ির প্রাচীরটা ভেঙে গেছে।

(খ) সম্বোধন পদ– সম্বোধন করার অর্থ হল ডাকা বা আহ্বান করা। যে পদের সাহায্যে কাউকে সম্বোধন করা হয় বা ডাকা হয় সেই পদকে সম্বোধন পদ বলা হয়। সম্বোধন পদের সঙ্গেও ক্রিয়াপদের সরাসরি সম্পর্ক থাকে না। তাই এটি অকারক পদ। যেমন-

১) মহারাজা, আদেশ করুন
২) দাদা, এইদিকে আসুন।
৩) মহাশয়, আপনার নাম কী?
৪) হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে।
৫) এই যে দিদি, এইদিকে সিট আছে।

সন্ধিবিচ্ছেদ  সূচিপত্র  শব্দ ও পদ

error: Content is protected !!