আমার বাংলা- সম্পূর্ণ আলোচনা

দ্বাদশ শ্রেণিঃ পূর্ণাঙ্গ বাংলা সহায়ক গ্রন্থ

আমার বাংলা || Amar Bangla by Subhas Mukhopadhyay 

কবি সুভাষ মূখোপাধ্যায়ের লেখা “আমার বাংলা” গ্রন্থটি শুধুমাত্র কবির চোখে দেখা বাংলাদেশের ইতিবৃত্তান্ত নয়, বরং বলা যেতে পারে এই গ্রন্থটি সমসাময়িক ভারতবর্ষের এক জীবন্ত দলিল। ছোটবেলায় মোনা ঠাকুরের মুখে শোনা কলকাতার গল্প, কবির নিজের চোখে দেখা কলকাতার পরিচয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীন ভারতের অবহেলিত মানুষের কথা- এসবই কবি লিপিবদ্ধ করেছেন এই গ্রন্থে। কবির বন্ধু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রংমশাল‘ পত্রিকার জন্য এই গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। যাইহোক, আমাদের পাঠ্যসূচীতে রয়েছে ৫টি অধ্যায়। সেগুলি হল

  • গারো পাহাড়ের নিচে
  • ছাতির বদলে হাতি
  • কলের কলকাতা
  • মেঘের গায়ে জেলখানা
  • হাত বাড়াও

তবে এই গ্রন্থ থেকে কোনো শর্ট বা এম সি কিউ আসবে না। বড় প্রশ্নের জন্য কয়েকবার মূল বইটিতে চোখ বোলালেই যথেষ্ট। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি তুলে ধরা হল। ভিডিওটি দেখলে এই গ্রন্থ থেকে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে।

গারো পাহাড়ের নিচে

এই অধ্যায়ে লেখক গারো পাহাড়ের নীচে বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাত্রার উপর আলোকপাত করেছেন। শুরুতেই রয়েছে তাদের চাষবাসের বর্ণনা। পাহাড়ি এলাকা, কেবল পাথর আর গাছ। ওই এলাকার মানুষজন চৈত্রমাসে পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাহাড়ে আগুন লাগালে ছোট বড় সব প্রাণী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে এবং তখন তাদের শিকার করা হয়। আগুন নিভলে সেই ছাইয়ের উপর তারা চাষাবাদ করে।

এই এলাকায় মূলত হাজং, গারো, কোচ, ডালু প্রভৃতি জনজাতির মানুষের বসবাস। পাহাড়ি জন্তুর ভয়ে গারোরা মাচার উপর বসবাস করে। রান্নাবান্না, খাওয়া, শোয়া সবই তাদের মাচার উপরে। হাজংরা কৃষিজীবী। বস্তুত গারোরাই তাদেরকে ‘হাজং’ নাম দিয়েছে। হাজং মানে হল ‘চাষের পোকা’। পাহাড়ি এলাকায় সবুজ ফসল ফলানো, সে তো কম মেহনতের নয়। কিন্তু এত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়েও হাজংদের জীবনে সুখ ছিল না; জমিদারের পাওনা মিটিয়ে তারা সর্বস্বান্ত হত।

এই অধ্যায়ের শেষ অংশে একটি অমানবিক প্রথার উল্লেখ রয়েছে, সেটি হল ‘হাতিবেগার’। মাঝে মাঝে জমিদারের শখ হত হাতি ধরার। উঁচু মাচার উপর সেপাই-সান্ত্রী নিয়ে নিরাপদে বসে থাকতেন তিনি আর হাতি ধরার কাজটা প্রজাদেরকেই করতে হতো। হাতি ধরার জন্য ছেলেবুড়ো সকলে জঙ্গল বেড় দিয়ে দাঁড়াত এবং এদের কেউ সাপের কামড়ে মরত, কেউ বাঘের পেটে যেত। অবশেষে, গোরাচাঁদ মাস্টারের নেতৃত্বে প্রজারা বিদ্রোহ করল এবং এই অমানবিক প্রথা বন্ধ হল।

গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

ছাতির বদলে হাতি

এই অধ্যায়ে একজন গারো চাষির কথা আছে। তার নাম চেংমান। সে এসেছিল হালুয়াঘাট বন্দরে সওদা করতে। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। নিরুপায় চেংমান মনমোহন মহাজনের দোকানের ঝাঁপির নীচে আশ্রয় নিল। তখন মনমোহন তার নতুন ছাতাটি চেংমানকে দেয় এবং তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে যে ছাতার টাকাটা পরে দিলেও চলবে। এরপর যতবারই চেংমান হাটে যেত, প্রত্যেকবারই মনমোহনকে বলতো ছাতার টাকাটা নেওয়ার জন্য। কিন্তু মনমোহন টাকা নিতেই চায় না। চেংমান বুঝে উঠতে পারে না হঠাৎ করে রক্তচোষা মহাজন ‘দয়ারসাগর’ হয়ে গেল কি করে! এইভাবে বছর কেটে যায় এবং একসময় চেংমান ছাতার কথাটা প্রায় ভুলেই যায়।

বছরখানেক পরের ঘটনা। চেংমান গেছে হাটে। মহাজন তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যায় এবং জাবদাখাতা খুলে তাকে দেখায় যে ছাতার জন্য তার ঋণের পরিমাণ প্রায় একহাজার টাকা! অর্থাৎ, প্রায় একটা হাতির দাম।

এই অধ্যায়েও আরেকটি কুপ্রথার উল্লেখ রয়েছে। সেটি হল নানকার প্রথা। নানকার জমিতে প্রজার স্বত্ব ছিলনা এবং জমির আম কাঁঠালের উপর তাদের অধিকার থাকত না। অথচ, জমি জরিপের পর আড়াইটা পর্যন্ত খাজনা সাব্যস্ত হত। খাজনা দিতে না পারলে প্রজাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হতো। শেষপর্যন্ত ডালু চাষিরা  ঐক্যবদ্ধ হয়ে জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং জমিদারের খামারে ফসল না তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

কলের কলকাতা

এই অধ্যায়টি বেশ বড়। লেখকের ছেলেবেলা থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ঘটনা এই অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। লেখক তাঁদের গ্রামের ছেলে মোনা ঠাকুরের মুখে কলকাতার গল্প শুনতেন। কালীঘাট থেকে মোনা ঠাকুরের পৈতে হয়েছিল। তার সেই কলকাতা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার কথা সমবয়সী ছেলেদের শোনাত মোনা ঠাকুর। তার বছর পাঁচেক পরে লেখকদের পরিবার কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। সেই প্রথম লেখক নিজের চোখে দেখেন কলের কলকাতা। প্রথম প্রথম কলকাতাকে ভালো লাগেনি লেখকের। গ্রামের আলোহাওয়া-পূর্ণ পরিবেশের তুলনায় কলকাতাকে অনেক বেশি নীরস মনে হয়েছিল তাঁর।

বিকেলে একাই ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন কলকাতার অলিগলি। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল লেখকের। তারপর একসময় নিজের অজান্তে, কখন যে কলকাতাকে ভালবেসে ফেলেছিলেন লেখক তা বুঝতেও পারেননি।

এদিকে, কলকাতা তখন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। মিটিং, মিছিল, স্বদেশী আন্দোলন – এসবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল লেখকের কৈশোরকাল। দেশভক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছিলেন লেখকের স্বপ্নের নায়ক। একদিন তো তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও দেখলেন স্বচক্ষে।

সারাটা দেশ যেন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাদের জন্য লেখকের গর্ব হত। তবে, সবাই যে প্রকৃত দেশ প্রেমিক ছিলেন তা নয়, অনেক ভন্ডও ছিল। যেমন, লেখকদের বাড়িমালিক রামদুলালবাবু যিনি নিজের মাইনে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে জেলে গিয়েছিলেন। লেখকের নিজের উপর রাগ হয়, কারণ একদিন এই লোকটাকে লেখক নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক ভেবেছিলেন।

লেখকদের বাড়িতে আসতেন এক সরকারি উকিল। মুখে তার দেশপ্রেমের কথা কিন্তু কাজের বেলায় উল্টো। তিনি ইংরেজদের হয়ে বাংলার বীরদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর ব্যবস্থা করতেন বলেই লেখকের মতে ‘লোকটা পয়লা নম্বরের ভন্ড।’ তার সম্পর্কে লেখক বলেছেন “এরা মানুষ না আর কিছু?”

যাইহোক, অনেক তাজা প্রাণের বিনিময়ে শেষপর্যন্ত স্বাধীনতা আসে। দেশ স্বাধীন হয়, দেশ ভাগ হয়। স্বাধীন ভারতেও হিংসার আগুন অব্যাহত থাকে।

গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

মেঘের গায়ে জেলখানা

“আমার বাংলা” গ্রন্থের এই অধ্যায়টিও বেশ বড়। প্রথম অংশে রয়েছে লেখককের যাত্রাপথের বর্ণনা। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গেলে হাওড়া থেকে ‘তিন দিন তিন রাত্তিরের পথ’। ট্রেন গিয়ে থামবে সাহেবগঞ্জে। সেখানে ট্রেন বদলিয়ে সকরিগলি ঘাট। সেখান থেকে স্টিমারে করে যেতে হবে মনিহারি ঘাটে। এভাবেই লেখক তাঁর পুরো যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন। পাহাড়ি রাস্তা, বনজঙ্গল, চা বাগান এবং এসব দেখতে দেখতে বক্সার জেল পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। এই অংশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

এরপর আছে বক্সার জেলার বর্ণনা। পাহাড়ের তিন তলা সমান একটা হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে জেলখানাটা, মনে হবে মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঘর, পাথরের দেয়াল এবং কাঠের ছাদ। লেখক জেলখানার কর্মচারী, কয়েদি এবং ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে বক্সার জেলখানায় বন্দি বিভিন্ন কয়েদির কথা।

এই জেলেই বন্দি আছে সাধুচরণ। নাম সাধুচরণ হলেও আসলে সে একজন চোর। একসময় চুরি করা ছেড়ে দিয়ে সৎভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করেছিল সাধুচরণ। কিন্তু সে চুরি করা ছাড়লেও পুলিশ তাকে রেহাই দেয়নি। আশেপাশে কোথাও চুরি হলে পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে এসে মারধর করত। চুরি না করেও যেহেতু তাকে মার খেতে হত, তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে আবার চুরি করবে।

এই জেলখানাতেই বন্দি কিশোর অপরাধী মুস্তাফা। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে সংসার চালানোর জন্য অপরাধের রাস্তা বেছে নিতে হয়েছে তাকে।

লেখক বক্সার জেলার সমস্ত বন্দীদের দুটো শ্রেণীতে ভাগ করেছেন- ১) সুয়োরানীর ছেলে এবং ২) দুয়োরানীর ছেলে। যারা ধনীর সন্তান তাদেরকে লেখক সুয়োরানীর ছেলে বলেছেন। তারা মারাত্মক অপরাধ করে জেলে আসে। কিন্তু জেলের কর্তাব্যক্তিরা তাদেরকে আপনি-আজ্ঞা করে। আর যারা পেটের দায়ে পকেটমারি বা ছোটখাটো অপরাধ করে, তাদের কপালে জুটে অমানুষিক নির্যাতন।

বক্সার জেলের কয়েদিরা নিজেদের শরীরের মধ্যে টাকা রাখবার কল বানাত। কীভাবে বানাত সেই কল, লেখক সেই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন

হাত বাড়াও

আমার বাংলা গ্রন্থের শেষতম পরিচ্ছেদ হল ‘হাত বাড়াও’। এখানে লেখক পঞ্চাশের মন্বন্তরের সমকালীন একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। ফরিদপুর যাওয়ার গাড়ি আসতে দেরি ছিল, লেখক বসে ছিলেন রাজাবাড়ির বাজারে। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে স্টেশনের রাস্তায় মিলিটারি ছাউনির পাশে অদ্ভুত একটা জন্তু। চার পায়ে ভর দিয়ে জন্তুটি লেখকের দিকেই এগিয়ে আসছিল। কাছে আসতেই লেখক বুঝতে পারলেন সেটা কোন জন্তু নয়, সেটি আসলে ‘অমৃতস্য পুত্র’ মানুষ। এই মানবপুত্রের মধ্য দিয়ে লেখক যুদ্ধ আর মন্বন্তর-পীড়িত বাংলার রূপটি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।

অলৌকিক ভাষাবিজ্ঞান

error: Content is protected !!