প্রকল্প- স্বরচিত গল্প

শ্রেণি- একাদশ

বাংলা প্রকল্প

বিষয়- স্বরচিত গল্প

গল্পের নাম- জালিয়াতি
লেখক- ………..(ছাত্র/ছাত্রীর নাম)

পর্ব- এক

সন্ধ্যে সাতটা। সাড়ে ছ’টার লোকালটা এতক্ষণে বাঁশি বাজাতে বাজাতে পেরিয়ে গেল। রোজকার মতো মা এখন রান্নাঘরে রুটি-সবজি করতে ব্যস্ত, পিকু পাশের ঘরে টিউশন পড়ছে আর মনীষা বিছানায় গুচ্ছেক বই নিয়ে বসে আছে।

একবার কলিং বেলটা বেজে উঠলো। কিন্তু সে শব্দ মনীষার কানে গেল না।

পাশের ঘর থেকে মা ডাক দিল- “মণি, দরজাটা খোল। বাবা এসেছে মনে হয়”। কিন্তু এবারেও কথাটা তার কানে গেল না।

মা দরজা খুলে মনীষার ঘরে এসে গর্জন শুরু করল- “পড়ছিস না ধ্যান করছিস”?

মনীষা বুঝতে পারল যে মা তাকে ডেকেছিল কিন্তু সে শুনতে পায়নি। এরকমটা এখন প্রায়ই হচ্ছে। মা রেগে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। সামনের বইটা থেকে দুয়েক লাইন পড়ে মনীষা আবার নিজের ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

মনীষা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নেই। এখন তার চাকরি করার ইচ্ছে। তার স্বপ্নের চাকরি হল নার্সিং। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন যে সে নার্স হবে। অবস্থাটা এমন যে, এখন সে চোখ বন্ধ করলে নিজেকে নার্সের পোশাকে দেখতে পায়। কিন্তু নার্স হব বললেই তো হওয়া যায় না। এখনকার সব বুদ্ধিমতি মেয়েদের নজর ওই একটা চাকরির দিকে। নব্বই শতাংশ নাম্বার পেলে পর হয়তো সরকারি নার্সিং কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। এই নাম্বারটাই এখন তার স্বপ্নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যতই চেষ্টা করুক ওর পক্ষে এত নাম্বার পাওয়া সম্ভব নয়।

মনীষা এখন দিনরাত ওই ভাবনাতেই ডুবে থাকে। নার্স হবার চিন্তায় পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। সারাক্ষন অন্যমনস্ক থাকে এবং সেজন্য মাঝে মাঝে মায়ের কাছে বকাও খেতে হচ্ছে। এই যে একটু আগে তার বাবা এসে পাশে বসেছে, এটাও পর্যন্ত সে জানতে পারেনি। মেয়েকে অন্যমনস্ক দেখে বললেন-

‘কী এত ভাবিস রে সারাক্ষন?’

হঠাৎ বাবার গলা শুনে মনীষা প্রায় চমকে উঠেছিল। থতমত খেয়ে সে বলল- ‘কই না তো। কিছু ভাবছি না বাবা’।

বাবা বললেন- ‘আর ক’দিন বাকি’?
– পনেরো দিন।
– সব বিষয়ের সিলেবাস শেষ?
– হুম।
– কত পার্সেন্ট পাবি মনে হচ্ছে?

মনীষা চুপ করে থাকে। বাবা শান্ত সুরে বলে- ‘এতো কী ভাবনা! আরে পাস তো করতে পারবি? ওতেই হবে’।

মনীষা বলে- ‘ওইরকম পাস করে কী হবে বাবা’?
– যা হবার হবে, না হয় না হবে। তোদের দু’ ভাইবোনকে কোনোদিন বেশি নাম্বারের জন্য চাপ দিয়েছি কি’?
– কিন্তু বাবা কম নাম্বার পেলে যে নার্স হতে পারবো না।
বাবা হেসে বলেন- ‘এখন ওইসব ভেবে মাথা খারাপ করতে নেই। উচ্চমাধ্যমিকের পর ভাবা যাবে। চল, খেয়ে নিবি চল তো।’ বলেই তিনি রান্নাঘরের দিকে যান। মনীষা মুখ ব্যাজার করে বসে থাকে।

উচ্চমাধ্যমিকের পরে এইসব চিন্তা করলে হয়তো কোনো ক্ষতি হত না। কিন্তু ও যেন নিশ্চিত হয়ে বসে আছে যে এত নাম্বার পাবে না। তবে হাল ছাড়বার পাত্রী সে নয়। এইজন্য বিকল্প একটা রাস্তাও সে খুঁজে রেখেছে। অনেক খোঁজখবর নিয়ে সে এমন একজনের সন্ধান পেয়েছে যে কিনা সবার জন্য নার্সিংয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। সে যে-সে লোক নয়, কোনো সরকারি নার্সিং কলেজের প্রিন্সিপাল। এখনো পর্যন্ত অনেকের করে দিয়েছে সে। কিন্তু সবই গোপনে। প্রিন্সিপাল ভদ্রলোকের চাহিদা বেশি নয়। মোট দু’লাখ টাকা- অগ্রিম এক লাখ আর ভর্তি হবার পর বাকিটা।

ওদিকে মা তখন খাবার জন্য ডাক দেয়। মনীষা শুনেও যেন শুনতে পায়না। এখন ওর একটাই চিন্তা যে এসব কথা বাবাকে বলবে কীভাবে? টাকাটা হয়তো বাবা দিয়ে দেবে কিন্তু সে ভাবছে “লোকটি দুয়েকদিনের মধ্যেই মাধ্যমিকের এডমিট কার্ড এবং রেজাল্ট জমা দিতে বলেছিল। বাবা রাজি হবে কিনা কে জানে!”

খাবার সময় মনীষা ভাবে যে বাবাকে বলবে ব্যাপারটা। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তার সাহস হয় না। মনীষার বাবা পেশায় একজন উকিল। মেয়ের মুখ দেখে তিনি বুঝতে পারেন। জিজ্ঞেস করেন- “কিছু বলবি?”

মনীষা কিছু বলার আগে তার মা ঝাঁঝিয়ে উঠেন- “কী আর বলবে? মেয়ে তোমার পরীক্ষায় ফেল করবে। ফেল করা মেয়েকে ঘরে রেখে লাভ নেই। তুমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা কর। আঠারো বছর হলেই বিয়ে দিয়ে দেব।”

মনীষা চুপ করে থাকে। মনে মনে সে ভাবে- “আমার বিয়েতে তোমরা খরচা কোরো না, বরং দু’লাখ টাকা দিয়ে নার্সিং পড়তে দাও। আমিও তো তোমাদের সন্তান। তবে আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চাও কেন?” এরকম অনেক কথাই তার মাথায় আসে কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না।

পর্ব- দুই

বইগুলি গুছিয়ে রেখে বিছানা পরিষ্কার করে মনীষা। কিন্তু আজ বিছানায় শুয়েও কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। তার কেবলই মনে পড়ছে সেই প্রিন্সিপালের কথা- “বেশি সিট নেই। যা করার জলদি করবে”। কী করবে সে ভেবে পাচ্ছিল না। এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাৎ করেই তার মাথায় এল আইডিয়াটা।

মনীষার নার্সিং কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রয়োজন মাত্র দু’লাখ টাকা। সে তো তার কাছেই রয়েছে! অবশ্য কাছে নয়, ব্যাংকে রয়েছে- তার নিজের একাউন্টে। মনীষার মামাতো দাদু ছিলেন ইস্কুলমাস্টার, কদিন আগেই তিনি রিটায়ার করলেন। সেই মাস্টার-দাদুই মনীষার জন্য দু’লাখ টাকা দিয়েছিল মনীষার মাকে। সেই টাকাটা তো তার নিজের একাউন্টেই রয়েছে। তাহলে আর চিন্তা কী!

না না, চিন্তা নেই বললেও ভুল হবে। কী করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হয়, আর এতগুলো টাকা তাকে দেওয়া হবে কিনা- এসব কিছুই জানে না মনীষা। তার তো এখনো আঠারো বছর বয়স হয়নি। তবে সে না জানলে কী হবে, ওর অনেক বন্ধুই এসব জানে। অনেকে তো অনলাইনে শপিং পর্যন্ত করে। টাকাটা না হয় কোনো বন্ধুকে দিয়ে তোলানো যাবে। আর মাধ্যমিকের এডমিট এবং রেজাল্ট তো তার কাছেই রয়েছে। সুতরাং, কালকেই সেই প্রিন্সিপালের কাছে যাওয়া যেতে পারে। মনে মনে খুশি হয় মনীষা।

একবার করে সে ভাবে, এতগুলো টাকা বাড়ির কাউকে না জানিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা। পরে যদি জানাজানি হয়, সবাই খারাপ ভাববে। কিন্তু ওরা যখন আসল ব্যাপারটা জানবে, নিশ্চয়ই খুশি হবে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রসন্ন মনে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

পর্ব- তিন

ঘড়িতে তখন সকাল ছ’টা। ড্রইং রুমে কেউ একজন জোরে জোরে কথা বলছে। সেই কথার শব্দেই মনীষার ঘুম ভেঙে গেল। সামনেই তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, কিন্তু ঘড়ি ধরে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে সে। এলার্ম দেওয়া থাকে। তার আগে কেউ তাকে ঘুম থেকে জাগায় না। কারণ, সবাই জানে পরীক্ষা বলেই মেয়েটা রাত জেগে পড়াশোনা করেছে।

মনীষা আরো ঘুমিয়ে যেত কিন্তু আগন্তুক ভদ্রলোকের কথাগুলো কানে আসছিল। ‘নার্সিং’, ‘নার্সিং কলেজ’ এরকম কিছু একটা বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলছিল লোকটি। মনীষা জোর করে ঘুম মুছে ফেলে বিছানায় বসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।

তার পরিকল্পনার কথা কেউ টের পেয়ে গেল নাকি! ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে মনীষার। বাড়িতে গোপন করে মনীষা এতসব করতে যাচ্ছিল- এই কথা যদি মায়ের কানে পৌঁছায়, তাহলে আর রক্ষে নেই। ভয়ে ভয়ে ড্রয়িং রুমের কাছে এসে দাঁড়াল সে।

এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে মনীষা। সেই ভদ্রলোক মনীষার বাবাকে যা যা বলছিল তার সারমর্ম এইরকম- “সদর বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি লজ থেকে গতকাল রাত্রে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। লোকটি নিজেকে একটি সরকারি নার্সিং কলেজের প্রিন্সিপাল বলে পরিচয় দিত। নার্সিং কলেজে এডমিশন পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কিছু মানুষের টাকা হাতিয়েছিল সে। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং তার অফিস থেকে বেশ কিছু নথিপত্র উদ্ধার করে।”

এসব কথা শুনে মনীষা ঘামতে শুরু করে। আরেকটু হলে সেও তো একই ভুল করতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস সে টাকাটা দিয়ে দেয়নি।

মনীষার বাবাকে যিনি এই কথাগুলি বলছিলেন, তিনি নিজেও প্রতারিত হয়েছেন। মেয়েকে নার্সিং কলেজে ভর্তি করার জন্য তিনিও কয়েক লাখ টাকা দিয়ে বসে আছেন। মনীষার বাবা উকিল। টাকাটা যাতে উদ্ধার করা যায় সেইজন্য ভদ্রলোক তার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছেন।

সব শুনে মনীষার বাবা লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন- “আপনারা শিক্ষিত মানুষ হয়েও এরকম ফাঁদে পা দেন কী করে? একটু চোখ কান খোলা রেখে পথ চললে বুঝতে পারবেন যে এরকম জালিয়াতির কারবার এখন চারদিকে চলছে”।

মনীষা একইসঙ্গে ভয় আর স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামনের সোফাটায় ধপাস করে বসে পড়ল সে। না, আর কোনো ভাবনা-চিন্তা নয়। এখন শুধু একটাই চিন্তা- সামনে উচ্চমাধ্যমিক।

error: Content is protected !!