বাংলা সমাস

সমাস

পরস্পর সন্নিহিত এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুই বা ততোধিক পদের মিলনকে বলা হয় সমাস। শুধু পাশাপাশি থাকলেই হবে না, যে পদগুলির সমাস হবে তাদের মধ্যে অর্থসম্বন্ধ থাকতে হবে। ব্যাকরণের আলোচনায় সমাস বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাসের কাজ-

১) সংক্ষিপ্তকরণ- সমাস পাশাপাশি অবস্থিত দুটি বা তার বেশী পদকে এক পদে পরিণত করে বাক্যটিকে সংক্ষিপ্ত রূপ দেয়। যেমন- ‘অবধানের সহিত বর্তমান থেকো।’- এই বাক্যটির ‘অবধানের সহিত বর্তমান’ পদগুলি একপদে পরিণত করলে হয় ‘সাবধান’। তাহলে বাক্যটি হল ‘সাবধানে থেকো।’

বাংলা সমাস

২) শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি- সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমেই শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি করে। যেমন-
‘ রাজার পুত্র রাজার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন।’ এই বাক্যটিকে যদি এইভাবে বলা হয়- ‘রাজপুত্র রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন’, তাহলে শুনতে ভালো লাগে।

৩) নতুন শব্দ গঠন- সমাসের প্রধানতম ভূমিকা হলো নতুন শব্দ সৃষ্টি। সমাস হল শব্দ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। বাংলা শব্দভান্ডারের বহু শব্দ রয়েছে যেগুলি আসলে সমাসবদ্ধ পদ।

সন্ধি বনাম সমাস

প্রথমত, সন্ধিতে বর্ণের সঙ্গে বর্ণের মিলন ঘটে কিন্তু, সমাসে পদের সঙ্গে পদের মিলন হয়।

দ্বিতীয়ত, সন্ধিতে অর্থ-সম্পর্ক বড় কথা নয় কিন্তু সমাসের ক্ষেত্রে অর্থ-সম্পর্কটাই আসল। পরস্পর সন্নিহিত দুটি পদের মধ্যে অর্থ সম্পর্ক না থাকলে সমাস হয় না।

তৃতীয়ত, সন্ধিতে সন্ধিবদ্ধ পদগুলির অর্থ অপরিবর্তিত থাকে কিন্তু, সমাসের ক্ষেত্রে অর্থ পরিবর্তিত হতেও পারে।

চতুর্থত, সন্ধিতে পদের ক্রম বজায় থাকে কিন্তু, সমাসে কখনও কখনও পদের ক্রম পরিবর্তিত হয়।

সমাসের বিভিন্ন উপাদান

সমাস বিষয়টি ভালো করে আয়ত্ত করতে গেলে এই জিনিসগুলো জানা প্রয়োজন-

১) সমস্যমান পদ– যে পদগুলি মিলিত হয়ে সমাসবদ্ধ পদটি গঠন করে তাদেরকে বলা হয় সমস্যমান পদ। সমাসে সাধারণত দুটি পদের মিলন ঘটে। এদের প্রথমটিকে বলা হয় পূর্বপদ এবং পরেরটিকে বলে পরপদ বা উত্তরপদ। এই দুটি পদের মাঝখানে অতিরিক্ত কোনো পদ থাকলে তাকে বলে মধ্যপদ।

২) সমাসবদ্ধ পদ বা সমস্তপদ– সমস্যমান পদগুলি মিলিত হয়ে যে নতুন পদটি গঠন করে তাকে বলা হয় সমাসবদ্ধ পদ বা সমস্তপদ।

৩) ব্যাসবাক্য– যে বাক্য দ্বারা সমাসবদ্ধ পদটিকে ব্যাখ্যা করা হয় তাকে ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য বলে। একটি উদাহরণের সাহায্যে তিনটি বিষয় পরিষ্কার করা যাক।

[রাজা, পুত্র] রাজপুত্র= রাজার পুত্র

উপরের উদাহরণে, রাজা এবং পুত্র পদদুটি হল সমস্যমান পদ। রাজা হল পূর্বপদ এবং পুত্র হল পরপদ। এরা মিলিত হয়ে ‘রাজপুত্র’ পদটি গঠন করল। অতএব, রাজপুত্র হল সমাসবদ্ধ পদ বা সমস্তপদ। এই সমস্তপদকে ব্যাখ্যা করলাম এইভাবে- রাজপুত্র= রাজার পুত্র। ‘রাজার পুত্র’ বাক্যটি হল ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য।

সমাসের শ্রেণিবিভাগ

সমাসের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ সংস্কৃত ব্যাকরণের সমাস অনুসরণ করে বাংলা সমাসের শ্রেণিবিভাগ করেছেন, আবার কেউ সংস্কৃতের প্রভাব মুক্ত হয়ে বাংলা সমাসের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। আলোচনা প্রসঙ্গেই সেইসব বিতর্কগুলি তুলে ধরা হবে। এখন সেসব বিতর্কে না গিয়ে দেখে নেওয়া যাক সমাসের প্রধান ভাগসমূহ। প্রতিটি ভাগের একটি করে ব্যাসবাক্যসহ সমাসের উদাহরণ দেওয়া হল।

১) তৎপুরুষ – রাজপুত্র= রাজার পুত্র
২) কর্মধারয় – মহারাজা= মহান যে রাজা
৩) দ্বন্দ্ব – পিতামাতা = পিতা ও মাতা
৪) বহুব্রীহি – গৌরাঙ্গ= গৌর অঙ্গ যার
৫) দ্বিগু – পঞ্চবটি= পঞ্চ বটের সমাহার
৬) অব্যয়ীভাব- উপকূল= কূলের সমীপে
৭) নিত্য – দেশান্তর= অন্য দেশ

এছাড়াও অনেকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস এবং অলুক সমাসকে আলাদা শ্রেণিভূক্ত করেছেন। এই দুটি সমাস সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে। এখন দেখে নেওয়া যাক সমাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সমস্যমান পদগুলির ভূমিকা। সমাসবদ্ধ পদে সমস্যমান পদগুলির (অর্থাৎ, যে পদগুলি মিলিত হচ্ছে) মধ্যে কোনটির (পূর্বপদ নাকি পরপদ) অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে তার ভিত্তিতে সমাসের শ্রেণিকরণ হয়ে থাকে। যেমন-

পূর্বপদের প্রাধান্য- অব্যয়ীভাব,
পরপদের প্রাধান্য- কর্মধারয় ও তৎপুরুষ,
উভয় পদের প্রাধান্য- দ্বন্দ্ব,
কোনো পদের প্রাধান্য নেই- বহুব্রীহি।

উপরের উদাহরণগুলি দেখলে বোঝা যাবে কোন সমাসে পূর্বপদ আর কোনো সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন-

অব্যয়ীভাব সমাস– ‘উপকূল’ সমাসবদ্ধ পদটির পূর্বপদ ‘উপ’ এবং পরপদ ‘কূল’। ‘উপকূল’ বলতে ‘কূল’ বোঝায় না, বোঝায় ‘কূলের সমীপে’ বা কাছাকাছি। তার মানে, পূর্বপদের অর্থ প্রাধান্য পেল।

কর্মধারয় সমাস– ‘মহারাজা’ সমাসবদ্ধ পদটির দুটি সমস্যমান পদ হল মহা (পূর্বপদ) এবং রাজা (পরপদ)। ‘মহারাজা’ বলতে কাকে বোঝাচ্ছে? ‘মহা’কে নাকি ‘রাজা’কে? অবশ্যই ‘রাজা’কেই বোঝাচ্ছে। তার মানে কর্মধারয় সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য থাকে।

তৎপুরুষ সমাস– ‘রাজপুত্র’ সমাসবদ্ধ পদটির পূর্বপদ হল রাজা এবং পরপদ হল পুত্র। ‘রাজপুত্র’ বলতে রাজাকে বোঝায় না, পুত্রকেই বোঝায়। সুতরাং, এখানেও পরপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে।

দ্বন্দ্ব সমাস– ‘পিতামাতা’ সমাসবদ্ধ পদটিতে দুটি সমস্যমান পদ রয়েছে- পিতা হল পূর্বপদ এবং মাতা হল পরপদ। ‘পিতামাতা’ বলতে কিন্ত একা পিতা বা মাতাকে বোঝায় না, উভয়কেই বোঝায়। সুতরাং, দ্বন্দ্ব সমাসে উভয় সমস্যমান পদের অর্থই প্রাধান্য পেল।

দ্বিগু এবং নিত্য সমাসের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। দ্বিগু সমাসের পূর্বপদটি একটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ হয় এবং সমস্যমান পদটি পরপদের সমাহার বা সমষ্টিকে বোঝায়। এটাই দ্বিগু সমাসের লক্ষণ। যেমন, উপরের উদাহরণে রয়েছে, পঞ্চবটী= পঞ্চ বটের সমাহার। পূর্বপদ ‘পঞ্চ’ হল একটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ এবং ‘পঞ্চবটী’ বলতে পঞ্চ (বা, পাঁচটি) বটগাছের সমাহার বা সমষ্টি বোঝায়।

অপরদিকে, নিত্য সমাসে ব্যাসবাক্যে নতুন একটি পদ আমদানি করা হয়। যেমন, ‘দেশান্তর’ সমাসবদ্ধ পদটির সমস্যমান পদগুলি হল ‘দেশ’ এবং ‘অন্তর’। কিন্ত, ব্যাসবাক্য হল অন্য দেশ; যদি বলা হত দেশের অন্তর, তাহলে অন্য অর্থ হয়ে যেত। সেইজন্য ‘অন্য’ পদটি আমদানি করা হল।

সমাসের প্রধান ভাগগুলি নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনার কারণ হল, এই বিষয়টি বুঝে নিতে পারলে সমাস নির্ণয় করা সহজ হবে। তাই আলোচনাটি এত দীর্ঘায়িত হল। এবার দেখে নেওয়া যাক প্রতিটি সমাসের উপভাগগুলি।

তৎপুরুষ সমাস

তৎপুরুষ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘তস্য পুরুষঃ’ বা তার (পরপদের) প্রাধান্য। যে সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি বা অনুসর্গ লােপ পায় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন-
১. রাজার প্রাসাদ= রাজপ্রাসাদ
২. গৃহের কর্তা= গৃহকর্তা

তৎপুরুষ সমাসের ভাগসমূহ

১) কর্ম তৎপুরুষ– এই তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে কর্মকারকের বিভক্তি থাকে এবং সমাসবদ্ধ হবার পর সেই বিভক্তিটি লোপ পায়। যেমন-
১. বধুকে বরণ = বধূবরণ
২. রথকে দেখা = রথদেখা
৩. বিপদকে আপন্ন= বিপদাপন্ন।

২) করণ তৎপুরুষ– এই তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে করণকারকের বিভক্তি বা অনুসর্গ থাকে এবং সমস্তপদে তা লােপ পায়। যেমন-
১. বিজ্ঞান দ্বারা সম্মত = বিজ্ঞানসম্মত
২. মন দ্বারা গড়া = মনগড়া
৩. তৃণশূন্য = তৃণ দ্বারা শূন্য।

৩) নিমিত্ত-তংপুরুষ– এই তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে নিমিত্ত কারকের অনুসর্গ থাকে এবং সমস্তপদে তা লােপ পায়। যেমন-
১. বিদ্যার নিমিত্ত আলয়= বিদ্যালয়
২. ডাকের নিমিত্ত মাশুল= ডাকমাশুল
৩. বিয়ের জন্য পাগল= বিয়েপাগল।

৪) অপাদান-তৎপুরুষ– এই তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে অপাদান কারকের বিভক্তি বা অনুসর্গ থাকে এবং সমস্তপদে তা লােপ পায়। যেমন-
১. বিলাত হইতে ফেরত = বিলাতফেরত
২. পদ হইতে চ্যুত= পদচ্যুত
৩. স্কুল থেকে পালনো = স্কুলপালানাে।

৫) অধিকরণ-তৎপুরুষ– এই তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদে অধিকরণ কারকের বিভক্তি থাকে এবং সমস্তপদে তা লোপ পায়। যেমন-
১. গাছে পাকা = গাছপাকা
২. গােলাতে ভরা = গােলাভরা
৩. জলে মগ্ন= জলমগ্ন।

৬) সম্বন্ধ তৎপুরুষ– এই তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সম্বন্ধসূচক বিভক্তি লােপ পায়। যেমন-
১. ধানের খেত= ধানখেত
২. মামার বাড়ি = মামাবাড়ি
৩. বামুনদের পাড়া = বামুনপাড়া।

৭) না-তৎপুরুষ– যে তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদে না-বাচক শব্দ থাকে, তাকে না-তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন-
১. নয় অভিজ্ঞ = অনভিজ্ঞ
২. নয় শিক্ষিত = অশিক্ষিত
২. নয় উত্তীর্ণ = অনুত্তীর্ণ।

৮) উপপদ তংপুরুষ– কৃৎ প্রত্যয়ান্ত শব্দকে বলা হয় কৃদন্ত পদ এবং তার পূর্ববর্তী পদকে বলা হয় উপপদ। যে তৎপুরুষ সমাসে উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের সমাস হয়, তাকে উপপদ-তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। যেমন-
১. অন্ধ করে যে = অন্ধকার
২. পঙ্কে জন্মে যে= পঙ্কজ
৩. অগ্রে জন্মে যে= অগ্রজ

৯) ব্যাপ্তি তৎপুরুষ– ব্যাপ্তি কথার অর্থ হল ব্যাপকতা বা বিস্তৃতি। একটি নির্দিষ্ট কালপর্বের বিস্তৃতি বোঝাতে ব্যাপ্তিবাচক পদের সঙ্গে নামপদের যে সমাস হয় এবং সমস্তপদে ব্যাপ্তিবাচক শব্দটি লোপ পায়, তাকে ব্যাপ্তি তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। যেমন-
১. চিরকাল ব্যাপিয়া স্থায়ী= চিরস্থায়ী
২. ক্ষণকাল ব্যাপিয়া স্থায়ী = ক্ষণস্থায়ী;
৩. নিত্যকাল ব্যাপিয়া আনন্দ = নিত্যানন্দ।

১০) ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদটি একটি ক্রিয়াবিশেষণ, তাকে ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। যেমন-
১. অর্ধ ভাবে মৃত = অর্ধমৃত
২. অর্ধ ভাবে স্ফুট= অর্ধস্ফুট
২. নিম রূপে রাজি= নিমরাজি।

১১) অলুক তৎপুরুষ– যে তৎপুরুষ সমাসে পুর্বপদের বিভক্তি লােপ পায় না, তাকে অলোপ বা অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন-
১. গরুর গাড়ি= গরুরগাড়ি
২. মামার বাড়ি= মামারবাড়ি
৩. তেলে ভাজা = তেলেভাজা।

[অনেকে অলুক সমাস নামে সমাসের আলাদা একটি শ্রেণির কথা বলেন এবং সেই অলুক সমাসের তিনটি ভাগ- ১) অলুক তৎপুরুষ, ২) অলুক দ্বন্দ্ব এবং ৩) অলুক বহুব্রীহি। অলুক সমাসকে আলাদা সমাস বলে ধরা হলে অলুক তৎপুরুষ সমাসকে তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণিতে না ধরে অলুক সমাসের একটি ভাগ হিসেবে ধরতে হবে।]

১২) উপসর্গ তৎপুরুষ– যে সমাসের প্রথম পদটি একটি উপসর্গ অথবা উপসর্গ স্থানীয় অব্যয় হয় এবং সমাসবদ্ধ পদে উক্ত উপসর্গ বা অব্যয়ের ভাবটি প্রধান ভাবে প্রতীয়মান হয়, তাকে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। যেমন-
১. কূলের সমীপে = উপকূল
২. মিলের অভাব = গরমিল
৩. মূর্তির সদৃশ = প্রতিমূর্তি।

[উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস হল অব্যয়ীভাব সমাসের বিকল্প নাম। যদি অব্যয়ীভাব সমাসের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় তবে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলে আলাদা কোনো সমাস হবে না। বাংলা সমাস থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব দূর করার উদ্দেশ্যে বাংলায় উপসর্গ সমাস নামটির উৎপত্তি। বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, উপসর্গ সমাস কিন্তু প্রকৃত বিচারে তৎপুরুষ সমাস নয়। কারণ, তৎপুরুষ সমাসে পরপদের অর্থটি প্রাধান্য পায় কিন্তু উপসর্গ তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের (অর্থাৎ, উপাসর্গ বা অব্যয় পদটির) প্রাধান্য থাকে। তাই উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস না বলে, একে অব্যয়ীভাব সমাস বলাই যুক্তিযুক্ত।]

কর্মধারয় সমাস

যখন দুটি বিশেষ্যপদ বা দুটি বিশেষণপদ কিম্বা একটি বিশেষ্য পদ ও একটি বিশেষণপদের মধ্যে সমাস হয় এবং সমাসবদ্ধ পদটিতে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তখন তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন-
১. মহান যে পুরুষ= মহাপুরুষ
২. যিনি রাজা তিনি ঋষি = রাজর্ষি
৩. কাঁচা অথচ মিঠে = কাঁচামিঠে।

কর্মধারয় সমাসের ভাগসমূহ

১) সাধারণ কর্মধারয় সমাস– দুটি বিশেষ্যপদ বা দুটি বিশেষণপদ কিম্বা একটি বিশেষ্য পদ ও একটি বিশেষণপদের মধ্যে সমাস হলে এবং সমাসবদ্ধ পদটিতে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পেলে, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। সাধারণ কর্মধারয় সমাস আসলে কর্মধারয় সমাসের সেই শ্রেণি যার মধ্যে অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, কর্মধারয় সমাসের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিই সাধারণ কর্মধারয় সমাসের লক্ষণ। কর্মধারয় সমাসের অন্যান্য ভাগগুলি দেখলে বোঝা যাবে এই সমাসটির নাম সাধারণ কর্মধারয় সমাস কেন হল। যাইহোক, সাধারণ কর্মধারয় সমাসের কয়েকটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক।
১. যিনি পিতা তিনি ঠাকুর= পিতাঠাকুর
২. মিঠে অথচ কড়া= মিঠেকড়া
৩. মহান যে আশয়= মহাশয়।

প্রথম উদাহরণে দুটি বিশেষ্য পদের (পিতা, ঠাকুর) মিলন হয়েছে, দ্বিতীয় উদাহরণে দুটি বিশেষণ পদের (মিঠে, কড়া) মিলন হয়েছে এবং তৃতীয় উদাহরণে একটি বিশেষণ (মহান) এবং একটি বিশেষ্য পদের (আশয়) মিলন হয়েছে।

২) মধ্যপদলােপী কর্মধারয় সমাস– যে কর্মধারয় সমাসের সমস্তপদে মধ্যপদটি লােপ পায়, তাকে মধ্যপদলােপী করমধারয় সমাস বলা হয়। অন্যভাবে বললে, যে কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্য করতে হলে পূর্বপদ এবং পরপদের মাঝখানে একটি পদ আনয়ন করতে হয় এবং সমস্ত পদে সেই মাঝখানের পদটি বা মধ্যপদটি লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলা হয়। যেমন-
১. সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন
২. পল মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন
৩. এক অধিক দশ = একাদশ।

এরপর কর্মধারয় সমাসের যে তিনটি ভাগ নিয়ে আলোচনা করা হবে সেগুলিকে উপমাবাচক কর্মধারয় সমাস বলা চলে। প্রায়শই একটি জিনিস বোঝাতে আরেকটি জিনিসের উপমা দেওয়া হয় অথবা, অন্য জিনিসের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমন, বলা হল-

“রাম শ্যামের মতো বুদ্ধিমান।” অর্থাৎ, শ্যাম বুদ্ধিমান এবং শ্যামের সঙ্গে রামের তুলনা করা হল। তুলনা করা হল কারণ রাম এবং শ্যামের মধ্যে একটি সাধারণ গুণ রয়েছে- তারা দুজনেই বুদ্ধিমান। তুলনা করার জন্য বা উপমা দেওয়ার জন্য দুই ব্যক্তি বা বস্তুর (এখানে, রাম ও শ্যাম) প্রয়োজন, তাদের মধ্যে একটি সাধারণ গুণ বা বৈশিষ্ট্য (এখানে, বুদ্ধিমান) থাকতে হবে এবং তুলনা বোঝানোর জন্য কোনো পদ (এখানে, মতো পদটি) থাকবে। এবার দেখে নেওয়া যাক, ব্যাকরণের পরিভাষায় এদেরকে কী কী বলা হয়।

[১] উপমান– যার সঙ্গে তুলনা করা হয়, সে উপমান। উপরের বাক্যে শ্যাম হল উপমান।

[২] উপমেয় বা উপমিত – যাকে তুলনা করা হয়, সে উপমেয় বা উপমিত। উপরের বাক্যে রাম হল উপমেয় বা উপমিত পদ।

[৩] সাধারণ ধর্ম– উপমান এবং উপমেয়ের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম বা গুণটি সাধারণ (Common) তাকে সাধারণ ধর্ম বলে। উপরের বাক্যটিতে ‘বুদ্ধিমান’ হল সাধারণ ধর্ম।

[৪] তুলনাবাচক শব্দ- একের সঙ্গে অপরের তুলনা করতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে তুলনা বাচক শব্দ। উপরের বাক্যটিতে ‘মতো’ হল তুলনাবাচক শব্দ। একই রকম শব্দ হল ন্যায়, সদৃশ, রূপ ইত্যাদি।

এবার দেখে নেওয়া যাক, উপমাবাচক কর্মধারয় সমাসগুলি কেমন হয়। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সমাসেই উপরের চারটি উপাদানের মধ্যে তিনটি থাকবে, একটি থাকবে না।

৩) উপমান কর্মথারয় সমাস– যে কর্মধারয় সমাসে উপমান পদের সঙ্গে সাধারণ ধর্মবাচক পদের সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলা হয়। যেমন-
১. কাজলের মতো কালাে = কাজলকালাে
২. শশকের মতাে ব্যস্ত = শশব্যস্ত
৩. ফুটির ন্যায় ফাটা= ফুটিফাটা।

৪) উপমিত কর্মধারয় সমাস– যে কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদের সঙ্গে উপমান পদের সমাস হয় এবং সাধারণ সাধারণ ধর্মের উল্লেখ থাকে না, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলা হয়। যেমন-
১. চরণ কমলের ন্যায়= চরণ কমলের ন্যায়
২. পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ
৩. অধর পল্লবের ন্যায় = অধরপল্লব।

৫) রূপক কর্মধারয় সমাস– যে কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদ এবং উপমান পদের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয়, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলা হয়। যেমন-
১. ভব রূপ সাগর= ভবসাগর
২. শোক রূপ অগ্নি = শোকগ্নি
৩. আঁখি রূপ পখি = আঁখিপাখি।

[উপমিত এবং রূপক কর্মধারয় সমাসের মধ্যে অনেক মিল আছে বলে অনেকের ভুল হয়। মনে রাখতে হবে, উপমিত কর্মধারয় সমাসে উপমান এবং উপমেয় পদের মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য কল্পনা করা হয় মাত্র কিন্তু রূপক কর্মধারয় সমাসে উপমান এবং উপমেয় পদগুলিকে অভিন্ন বলে ধরা হয়। যেমন-

চরণপদ্ম= চরণ পদ্মের ন্যায় (উপমিত কর্মঃ)
মনমাঝি= মন রূপ মাঝি (রূপক কর্মঃ)

প্রথম উদাহরণে বলা হয়েছে চরণ পদ্মের মতো। পদ্মের সঙ্গে চরণের বা পায়ের খুব বেশি মিল নেই, শুধু শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টিতে কারো চরণকে প্রস্ফুটিত কমলের মতো সুন্দর বলে মনে হয়েছে। এটা আপাত সাদৃশ্য এবং গভীরতা কম। তাই এটি উপমিত কর্মধারয়। দ্বিতীয় উদাহরণে বলা হয়েছে মন রূপ মাঝি। মাঝি যেমন নদীবক্ষে ভ্রাম্যমাণ, তেমনি অবস্থা মনেরও। আগের উদাহরণের তুলনায় এখানে মিলটা অনেক বেশি। এজন্য এটি রূপক কর্মধারয়।]

দ্বন্দ্ব সমাস

সাধারণ অর্থে, দ্বন্দ্ব বলতে বোঝায় বিরোধ বা বিবাদ। তবে, বিশেষ অর্থে দ্বন্দ্ব কথাটির অর্থ মিলন। সমাসের আলোচনায়, যে সমাসে সবকটি সমস্যমান পদের অর্থ বজায় থাকে তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন-
১. ছেলে ও মেয়ে = ছেলেমেয়ে
২. দিন ও রাত = দিনরাত
৩. ধনী ও দরিদ্র = ধনী-দরিদ্র।

দ্বন্দ্ব সমাসের ভাগ

১) সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস– সমার্থক বা প্রায়-সমার্থক দুই বা তার বেশি পদের মিলনে যে দ্বন্দ্ব সমাস হয়, তাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন-
১. ঘর ও বাড়ি = ঘরবাড়ি
২. কালি ও কলম = কালিকলম
৩. চিঠি ও পত্র = চিঠিপত্র।

২) বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব সমাস– পরস্পর বিপরীত অর্থবিশিষ্ট দুই বা তার বেশি পদের মিলনে যে দ্বন্দ্ব সমাস হয়, তাকে বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। অন্যভাবে বললে, দুই বা ততোধিক বিপরীতার্থক শব্দের মিলনে যে দ্বন্দ্ব সমাস হয়, তাকে বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন-
১. দিন ও রাত = দিনরাত
২. সাদা ও কালো = সাদাকালো
৩. জন্ম ও মৃত্যু = জন্মমৃত্যু।

৩) বহুপদী দ্বন্দ্ব– যে দ্বন্দ্ব সমাসে দুইয়ের অধিক পদ থাকে, তাকে বলে বহুপদী দ্বন্দ্ব বলা হয়। যেমন-
১. স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল= স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল
২. সত্য, শিব ও সুন্দর = সত্য-শিব-সুন্দর;
৩. রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ = রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ।

৪) অলুক বা অলােপ দ্বন্দ্ব সমাস– যে দ্বন্দ্ব সমাসের সমস্তপদে সমস্যমান পদগুলির বিভক্তি লোপ পায় না, তাকে অলুক দ্বন্দ্ব বা অলােপ দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন-
১. যেতে ও আসতে = যেতে-আসতে
২. ঘরে ও বাইরে = ঘরেবাইরে
৩. হাতে ও পায়ে = হাতেপায়ে।

৫) একশেষ দ্বন্দ্ব সমাস– যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলি মিলিত হয়ে ( অর্থাৎ, সমাসবদ্ধ পদে) বহুবচনের রূপ লাভ করে, তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়। যেমন-
১. তুমি, আমি ও সে = আমরা
২. তুমি ও সে = তােমরা
৩. সে এবং অন্যান্যরা= তারা (সাধু- তাহারা)।

তাছাড়া, দুটি ক্রিয়াপদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সমাস হতে পারে। যেমন- আসা ও যাওয়া = আসা-যাওয়া, লেখা ও পড়া = লেখাপড়া, দেখা ও শোনা= দেখাশোনা। আবার, দুটি সর্বনাম পদের মিলনেও দ্বন্দ্ব সমাস হতে পারে। যেমন- তুমি ও আমি =তুমি-আমি, এটা ও সেটা = এটা-সেটা, যাকে এবং তাকে = যাকে-তাকে। মনে রাখতে হবে, সমাস নির্ণয়ের সময় (বিশেষভাবে উল্লেখ না থাকলে) একশেষ দ্বন্দ্ব ও অলুক দ্বন্দ্ব ছাড়া অন্য ভাগগুলি উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই- দ্বন্দ্ব সমাস লিখলেই হবে।

বহুব্রীহি সমাস

যে সমাসে পূর্বপদ বা পরপদ কোনোটির অর্থ প্রাধান্য পায় না, বরং সমাসবদ্ধ পদটি একটি স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশ করে তাকে বলা হয় বহুব্রীহি সমাস। যেমন- বীণাপাণি = বীণা পাণিতে যাহার। এখানে পূর্বপদ বীণা, পরপদ পাণি। কিন্তু বীণাপাণি বলতে বীণাকে বা পাণিকে বোঝায় না, দেবী সরস্বতীকে বােঝায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ‘বহুব্রীহি’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো বহু (অনেক) ব্রীহি (ধান্য) যাহার। এবারে দেখে নেওয়া যাক বহুব্রীহি সমাসের ভাগগুলি-

১) সমানাধিকিরণ বহুত্রীহি সমাস– যে বহুব্রীহি সমাসে উভয়পদের বিভক্তি সমান থাকে এবং পূর্বপদাটিতে বিশেষণ থাকে, তাকে বলা হয় সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস। যেমন-
১. পীত অম্বর যার = পীতাম্বর
২. গৌর অঙ্গ যার = গৌরাঙ্গ
৩. দিক অম্বর যার = দিগম্বর।

২) ব্যধিকরণ বহুত্রীহি সমাস– যে বহুব্রীহি সমাসে সমস্যমান পদগুলি ভিন্ন বিভক্তিযুক্ত হয় এবং উভয় পদেই বিশেষ্যপদ থাকে, তাকে ব্যধিকরণ বহুবরীহি সমাস বলে। যেমন-
১. শূল পাণিতে যার = শূলপাণি
২. পদ্ম নাভিতে যার= পদ্মনাভ
৩. বীণা পাণিতে যার = বীণাপাণি।

৩) মধ্যপদলেপী বহুব্রীহি সমাস– যে বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যপদ লােপ পায়, তাকে মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি সমাস বলে। একে উপমাবাচক বহুব্রীহি সমাসও বলা হয়। যেমন-
১. চাঁদের মতো (সুন্দর) বদন যার = চাঁদবদন
২. কলমের ন্যায় (সুন্দর) লোচন যার= কমললোচন
৩. মীনের (অক্ষির) ন্যায় অক্ষি যার = মীনাক্ষী

৪) না-বহুব্রীহি সমাস– যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদে একটি না-বাচক শব্দ থাকে, তাকে না বহুব্রীহি সমাস বলা হয়। যেমন-
১. নাই লজ্জা যার = নির্লজ্জ
২. নাই রস যাতে= নীরস
৩. নাই বােধ যার = নির্বোধ।

৫) সহার্থক বহুব্রীহি সমাস– কোনোকিছুর সহিত বর্তমান বোঝাতে যে বহুত্রীহি সমাস হয়, তাকে সহার্থক বহুত্রীহি সমাস বলে। যেমন-
১. ধবার সহিত বর্তমান = সধবা
২. হিংসার সহিত বর্তমান= সহিংস
৩. জলের সহিত বর্তমান= সজল।

৬) সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস– যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ হয়, তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন-
১. দশ আনন যার = দশানন
২. ত্রি লোচন যার = ত্রিলোচন
৩. সে (তিনটি) তার যার = সেতার।

৭) ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস– একই বিশেষ্য পদ যদি পরপর দুবার ব্যবহৃত হয় এবং উভয়ের সাহচর্যে কোনো বিশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়, তবে উক্ত দুই পদের মিলনকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন-
১. হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি
২. লাঠিতে লাঠিতে যে লড়াই= লাঠালাঠি
৩. কানে কানে যে পরামর্শ = কানাকানি।

৮) অলুক বা অলােপ বহুরীহি সমাস– যে বহব্রীহি সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি লােপ পায় না,
তাকে অলুক বা অলােপ বহুত্রীহি সমাস বলে। যেমন-
১. হাতে ছড়ি যার = ছড়িহাতে
২. মাথায় ছাতা যার = ছাতামাথায় (ছাতিমাথে)
৩. কানে কলম যার= কানেকলম।

আবার, যে অলোপ বহুব্রীহি সমাসে কোনাে অনুষ্ঠান বােঝায়, তাকে অনুষ্ঠানবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন-
১. হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে= হাতেখড়ি
২. মুখে ভাত দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে= মুখেভাত
৩. গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়েহলুদ।

দ্বিগু সমাস

‘দ্বিগু’ শব্দটির অর্থ হল দুটি (দ্বি) গােরু (গো) দিয়ে যা কেনা হয়েছে। যে সমাসে পূর্বপদে একটি সংখ্যাবাচক শব্দ থাকে এবং সমস্তপদটি পরপদের সমষ্টি বা সমাহার বোঝায়, তাকে দ্বিগু সমাস বলা হয়। সংস্কৃতে দ্বিগু সমাস তিন প্রকার। কিন্তু বাংলায় কেবল সমাহার দ্বিগুর প্রচলন রয়েছে। যেমন-
১. পঞ্চবটী= পঞ্চ বটের সমাহার
২. সপ্তাহ= সপ্ত অহের সমাহার
৩. ত্রিলােক = ত্রি (তিন) লােকের সমাহার
৪. শতাব্দী= শত অব্দের সমাহার।

[সমাহার দ্বিগু সমাসের সঙ্গে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাসকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। উভয় সমাসেই পূর্বপদে থাকে একটি সংখ্যা। এইজন্য ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। মনে রাখতে হবে, সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস সমস্যমান পদের অর্থ না বুঝিয়ে নতুন কোনো অর্থ প্রকাশ করে। অপরপ্রান্তে, দ্বিগু সমাস কোনো কিছুর সমাহার বা সমষ্টিকে বোঝায়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে-

দশানন = দশ আনন যার

এটি বহুব্রীহি সমাস। যদি বলা হয় কেন? কারণ, দশানন মনে দশ নয়, আনন বা মুখও নয় নয়- দশানন কথার অর্থ রাবণ। রামায়ণ অনুসারে, রাবণের দশটি মুখ ছিল, সেই অর্থে দশানন। যদি বলা হত, দশানন= দশ আননের সমাহার। তাহলে কীরূপ অর্থ হতো? সেক্ষেত্রে দশানন কথার অর্থ হতো দশটি মানুষের মুখের সমষ্টি। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপারটাই অর্থহীন হয়ে যেত। এবারে আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক-

তেরাস্তা= তে (তিন) রাস্তার সমাহার

তেরাস্তা বলতে তিনটি রাস্তার সমাহার বা সামষ্টিকেই বোঝায়। এটি দ্বিগু সমাস। যেমন, বলা হয় ‘তেরাস্তার মোড়’, অর্থাৎ তিনটে রাস্তা যেখানে এসে মিশেছে। তেরাস্তার মতো চৌরাস্তা হবে দ্বিগু সমাস। কোনো সমাসবদ্ধ পদের অর্থ যদি তার পরপদের সমষ্টিকে বোঝায়, তবে সেটা দ্বিগু সমাস। আর যদি সমাসবদ্ধ পদটি অন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করে তবে সেটা বহুব্রীহি সমাস।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘সেতার’ নামে একটা বাদ্যযন্ত্র আছে এবং এই বাদ্যযন্ত্রে সাধারণত তিনটি তার থাকে। এইজন্য সেতার শব্দটির ব্যাসবাক্য হয় ‘সে (তিন) তার যার’। এটি সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ। কিন্তু অনেক ব্যাকরণ বইয়ে দেখা যায় সেতার শব্দের ব্যাসবাক্য বলা আছে ‘সে (তিন) তারের সমাহার’। ‘সেতার’ বলতে কি শুধু তিনটি তারের সমাহারকে বোঝায়? সেতার তো একটা বাদ্যযন্ত্র। সমস্যমান পদ ছাড়া অন্য কোনো অর্থ প্রকাশ করলে সেটা অবশ্যই বহুব্রীহি সমাস হবে।]

সমাহার দ্বিগু ছাড়া অন্য যেক’টি দ্বিগু সমাসজাত শব্দ বাংলায় রয়েছে তাদের ব্যাসবাক্য একটু অন্যরকম হয়। যেমন-
১. এককড়ি= এক কড়ি মূল্যে ক্রীত
২. তিনকড়ি= তিন কড়ি মূল্যে ক্রীত
৩. পাঁচকড়ি= পাঁচ কড়ি মূল্যে ক্রীত
৪. সাতকড়ি= সাত কড়ি মূল্যে ক্রীত
৫. ন’কড়ি= নয় কড়ি মূল্যে ক্রীত।

অব্যয়ীভাব সমাস

অব্যয়ীভাব সমাস- যে সমাসের প্রথম পদটি অব্যয় হয় এবং সমাসবদ্ধ পদে উক্ত অব্যয়ের ভাবটি প্রধান ভাবে প্রতীয়মান হয়, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলা হয়। যেমন-
১. নগরীর সমীপে = উপনগরী
২. ভিক্ষার অভাব= দুর্ভিক্ষ
৩. দিন দিন = প্রতিদিন
৪. মূর্তির সদৃশ = প্রতিমূর্তি
৫. ইষ্টকে অতিক্রম না করে= যথেষ্ট।

নিত্য সমাস

যে সমাসের সমস্যমান পদগুলি অবিগ্রহ বা নিত্য সম্বন্ধে থাকে এবং সেইজন্য সমস্যমান পদগুলি দিয়ে ব্যাসবাক্য করা যায় না, অথবা, অন্য পদ দিয়ে ব্যাসবাক্য গঠন করে সমাসবদ্ধ পদটির অর্থ বিশ্লেষণ করা হয়, তাকে নিত্য সমাস বলে। সংজ্ঞা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে নিত্য সমাস দু’রকম হতে পারে-

১) অবিগ্রহ নিত্য– যে সমাসের ব্যাসবাক্য কোনো ভাবেই সম্ভব নয়, তাকে অবিগ্রহ নিত্য সমাস বলে। যেমন- কৃষ্ণসর্প। কৃষ্ণসর্প শব্দটি দুটি শব্দযোগে গঠিত- কৃষ্ণ এবং সর্প। এখন যদি এর ব্যাসবাক্য করা হয় “কৃষ্ণ যে সর্প”, তাহলে সেটি ভুল হবে। কারণ কৃষ্ণবর্ণ বা কালো রঙের সাপ তো অনেক আছে কিন্তু কৃষ্ণসর্প হল বিশেষ একটি বিষধর সাপ। দুটি শব্দ দিয়ে তৈরি হলেও কৃষ্ণসর্প আসলে একটিই শব্দ এবং সেইজন্য এর ব্যাসবাক্য সম্ভব নয়।

২) অস্বপদ বিগ্রহ নিত্য– যে নিত্য সমাসের স্বপদ বা নিজের পদ (অর্থাৎ, সমস্যমান পদগুলি) দ্বারা বিগ্রহ বাক্য বা ব্যাসবাক্য গঠন করা সম্ভব নয় কিন্তু অস্বপদ বা অন্য পদ দ্বারা ব্যাসবাক্য করা সম্ভব, তাকে অস্বপদ বিগ্রহ নিত্য সমাস বলে। যেমন-
১. অন্য জন্ম= জন্মান্তর
২. অন্য দেশ = দেশান্তর
৩. গ্রামান্তর= অন্য গ্রাম
৪. একমাত্র= কেবল এক।

অলুক সমাস

যে সমাসের সমস্তপদে সমস্যমান পদের বিভক্তি লোপ পায় না তাকে অলুক সমাস বা অলোপ সমাস বলা হয়। অলুক সমাস তিন রকম-

১) অলুক দ্বন্দ্ব সমাস– যেমন, হাতে-পায়ে।
২) অলুক তৎপুরুষ সমাস– যেমন, তেলেভাজা।
৩) অলুক বহুব্রীহি– যেমন, গায়েহলুদ।

আগেই এই তিন প্রকার সমাস নিয়ে বলা হয়েছে, তাই এখানে আর বিস্তারিত আলোচনা করা হল না।

বাক্যাশ্রয়ী সমাস

নামকরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, যে সমাসে সমস্যমান পদগুলি একটি বাক্যকে বা বাক্যখন্ডকে আশ্রয় করে থাকে, তাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে। যেমন-
১. আমরা সব পেয়েছির দেশে এসে গেছি।
২. আজকের বিশেষ আকর্ষণ বসে আঁকো প্রতিযোগিতা

উপসর্গ সূচিপত্র বাক্য ও বাক্য পরিবর্তন

error: Content is protected !!