বিরাম চিহ্ন কী?
সূচিপত্র
বিরাম কথার অর্থ হল থামা। মানুষ একটানা কথা বলতে পারে না। কথা বলার সময় অর্থের প্রয়োজনে অথবা, বাগযন্ত্রের বিশ্রামের প্রয়োজনে বারবার থামতে হয়। এই থামার বিষয়টিকে লিখিত রূপ দিতে যেসব চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাদেরকে একত্রে বিরাম চিহ্ন বলে। বাংলায় আগে দুটি বিরামচিহ্নের ব্যবহার হতো। যথাঃ অর্ধবিরতি বোঝাতে একটি দাঁড়ি (।) এবং পূর্ণবিরতি বোঝাতে দুটি দাঁড়ি (।।) চিহ্ন। উনিশ শতকে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজির অনুকরণে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকার বিরাম চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।
বিভিন্ন বিরাম চিহ্ন
(১) কমা বা পাদচ্ছেদ বা প্রথম ছেদ [,]
ব্যাক্যের মধ্যে স্বল্পকাল বিশ্রামের জন্যে এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এক [১] সংখ্যাটি উচ্চারণ করতে যে পরিমাণ সময় লাগে, কমার জন্যে বিশ্রাম-কাল ঠিক ততটুকু। কমা চিহ্নের ব্যবহার-
[ক] সমজাতীয় একাধিক পদ যদি পরপর বসে, তাহলে তাদের মাঝে কমা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। যেমন-
বিশেষ্য– বাঘ, গরু, ছাগল প্রভৃতি এখানেই জল পান করে।
বিশেষণ– আমাকে বিদ্বান, পন্ডিত, স্কলার ইত্যাদি যা খুশি বল আমি তো জানি আমার ক্ষমতা কতটুকু।
সর্বনাম– সে, তুমি আর আমি যাব।
ক্রিয়া—আমি এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।
[খ] একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়া পরপর থাকলে তাদের মাঝখানে কমা বসে। যেমন-
ভালো করে ধুয়ে, মুছে, শুকিয়ে রোদে দাও।
[গ] সমজাতীয় একাধিক বাক্য বা বাক্যাংশ পর পর বসলে তাদের মাঝে কমা দিতে হয়। যেমন-
তোমার হল শুরু, আমার হল সারা।
[ঘ] বাক্যের শুরুতে হ্যাঁ, না ইত্যাদি অব্যয়ের পর কমা বসে। যেমন-
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। না, আজ যাচ্ছি না।’
[ঙ] উদ্ধৃতি চিহ্নের আগে কমা বসে। যেমন-
বাবা বললেন, ‘মন দিয়ে পড়াশোনা করো’।
[চ] সম্বোধন পদের পর কমা বসে। যেমন-
মাগো, আমায় ছুটি দিতে বল।
[ছ] নামের শেষে উপাধি বা বিশেষ পরিচয়ের উল্লেখ করতে হলে নামের শেষে একটি কমা দিয়ে উপাধিটি লিখতে হয়। যেমন-
‘আজকের অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করবেন ডঃ আশুতোষ শীল, সভাপতি, জেলা সংস্কৃতি মঞ্চ।’
(২) সেমিকোলন,অর্ধচ্ছেদ বা দ্বিতীয় ছেদ [;]
কমার থেকে বেশিক্ষন বিশ্রামের জন্য সেমিকোলন ব্যবহার করা হয়। সেমিকোলনে কমার দ্বিগুণ বিরাম-কাল। সেমিকোলনের ব্যবহার-
[ক] পরপর-সম্পর্কযুক্ত দুই বা ততােধিক বাক্য যদি একে অন্যের অঙ্গীভূত না হয়, তবে সেমিকোলন-চিহ্নের দ্বারা তাদের পৃথক করা হয়। যেমন-
‘এখনকার ঘরে ফুলদানিতে সত্যিকারের ফুল দেখতে পাওয়া যায়না; সুন্দর সুন্দর ফুলদানিতে সাজানো থাকে প্লাস্টিকের ফুল’।
[খ] কিন্তু, সতরাং, অতএব—এই সব অব্যয়ের পূর্ববর্তী বাক্যের শেষে সেমিকোলন বসে।যেমন-
‘সমস্ত সাক্ষী-প্রমাণ তোমার বিরুদ্ধে; এতএব, তোমার আত্মসমর্পণ করা উচিত হবে।’
(৩) দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ [।]
দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ হলাে বাক্য-সমাপ্তির চিহ্ন। ভাব বা অর্থের সম্পূর্ণতা বোঝাতে দাঁড়ি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। প্রশ্নবোধক এবং বিস্ময়সূচক বাক্য ছাড়া বাকি সব বাক্যের শেষে দাঁড়ি চিহ্ন বসে। যেমন-
‘তাই নিয়ে আমরা খুব হেসেছিলুম’।
‘ভেতরে এসো’।
‘তোমার মঙ্গল হোক’।
‘সব ফুলের সুগন্ধ থাকে না’।
(৪) কোলন বা দৃষ্টান্ত-চিহ্ন [:]
কোনো দৃষ্টান্ত দেওয়ার আগে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন-
‘বাক্যের অর্থ ত্রিবিধ। যথা: অভিধা, লক্ষণা এবং ব্যঞ্জনা’।
(৫) কোলন-ড্যাশ [:-]
কোলন-ড্যাশের ব্যবহার কোলনের মতোই।
(৬) জিজ্ঞাসা চিহ্ন বা প্রশ্ন-চিহ্ন [?]
প্রশ্ন বোঝাতে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। পূর্ণচ্ছেদের মতো জিজ্ঞাসা চিহ্নতেও বাক্যের সমাপ্তি হয়। জিজ্ঞাসা চিহ্নের ব্যবহার-
[ক] প্রশ্নাত্মক বাক্যের শেষে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। যেমন-
মাঝি, আজ কতদূর যেতে পারবে?
তোমার হাতে ওই জিনিসটা কী?
[খ] প্রশ্ন বােঝাতে একটিমাত্র শব্দের পরেও জিজ্ঞাসা- চিহ্ন বসে। যেমন-
এই লোকটা আসলে কে? দেশদ্রোহী? বিপ্লবী? জননেতা? নাকি, মুক্তিপথের অগ্রদূত?
[গ] সংশয় অথবা শ্লেষ বােঝাতে বন্ধনী-চিহ্নের মধ্যে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।যেমন-
তাহার মত মহাপুরুষ (?) এখনো পৃথিবীতে আছে বলেই চন্দ্রসূর্য এখনো ঠিক মতো উঠছে।
(৭) বিস্ময়সূচক চিহ্ন [!]
ভয়, বিস্ময়, শােক, ঘণা, আনন্দ ইত্যাদি আবেগ বােঝাতে বিস্ময়-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। বিস্ময়সূচক চিহ্নের ব্যবহারগুলি হল এইরকম-
[ক] ভয়, বিস্ময়, শােক, ঘৃণা, আনন্দ ইত্যাদি আবেগ বােঝাতে বাক্যের শেষে বিস্ময়-চিহ্ন বসে। যেমন-
আজ আমার আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা নেই!
এমন অঘটনও ঘটে!
[খ] আবেগসূচক অব্যয় পদের পরেও বিস্ময়-চিহ্ন বসে। যেমন-
ছি ছি! সে কী কথা!
হায় হায়! অকালে চলে গেল!
[গ] ভয়, বিস্ময় ইত্যাদি বােঝাতে একটি মাত্র শব্দের পরেও বিস্ময়-চিহ্ন বসে।যেমন-
খাবার! জল পর্যন্ত জোটেনি।
এতো যে সে রোগ নয়। একেবারে- রাজরোগ!
[ঘ] বিস্ময় বোঝাতে সম্বোধন পদের পরও বিস্ময়-চিহ্ন বসে। যেমন-
মহারাজ! অনুগৃহিত হইলাম।
ভগবান! আর কত সহ্য করতে হবে!
(৮) হাইফেন বা সংযােগ-চিহ্ন [-]
দুই বা তার বেশি পদের মধ্যে সংযােগ বােঝাতে হাইফেন বা সংযােগ-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। সাধারণত সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদগুলির মাঝখানে হাইফেন চিহ্ন বসাতে হয়। যেমন-
দেশের মাটির রূপ-রস-গন্ধ অতুলনীয়।
গঙ্গার ঘাটে কয়েকটি ছেলে-মেয়ে চান করছে।
(৯) ড্যাশ বা গতি-চিহ্ন [—]
ড্যাশ চিহ্নকে বলা হয় গতি চিহ্ন। এই চিহ্ন ব্যবহার করে বক্তব্যের মধ্যে গতির সঞ্চার করা হয়। এই চিহ্নের প্রয়োগ নিম্নরূপ।
[ক] বক্তব্যে গতি প্রকাশ করার জন্য ড্যাশ বা গতি চিহ্নের ব্যবহার করা হয়। যেমন-
মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণায়— প্রতিটি মানুষের মধ্যে দেখি তার প্রকাশ।
[খ]অসমাপ্ত বাক্যের পর ড্যাশ-চিহ্ন বসে। যেমন-
সে যে আসবো বলল— বাদ দাও তার কথা। তুমি যাচ্ছ কি না সেটাই বল।
[গ] ব্যাখ্যা বােঝাতে বাক্যের পরে ড্যাশ-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। যেমন-
এখন ব্যাকরণের জায়গা নিয়েছে ভাষাবিজ্ঞান — ভাষা আলোচনার বিজ্ঞানসম্মত শাস্ত্র।
[ঘ] প্রত্যক্ষ উক্তি বােঝাতে উক্তির পর্বে অনেক সময় ড্যাশ-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। যেমন-
মা বলল — কই পড়তে বোস।
ছেলেটি উত্তর দিল — আজ পেটে খুব ব্যথা।
(১০) ঊর্ধ্ব কমা বা লোপ-চিহ্ন [‘]
পদের মধ্যে কোনো বর্ণের লোপ ঘটলে সেখানে ঊর্ধ্বকমা বা লোপ-চিহ্ন বসে। যেমন-
কলিকাতা আছে ক’লকাতাতেই।
সবার’পরে মানুষ সত্য।
আর ক’দিন এই ভাবে চলবে?
(১১) কোটেশন বা উদ্ধৃতি-চিহ্ন [‘ এবং ” ]
কারও উক্তি অবিকৃতভাবে উদ্ধৃত হলে উদ্ধৃতি-চিহ্ন ব্যবহার করতে হয়। উদ্ধৃতি চিহ্ন একক (‘…’) হতে পারে আবার দ্বৈতও (“…”) হতে পারে। উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার-
[ক] প্রত্যক্ষ উক্তির ক্ষেত্রে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন-
মাস্টারমশাই বললেন, “আমি একবার যাবো?”
[খ] বাক্যের মধ্যে কোনো বিশেষ শব্দ থাকলে সেটিকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে লিখতে হয়। শব্দটি একাধিকবার ব্যবহৃত হলে শুধু প্রথমবারেই উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। যেমন-
প্রাচীন মিশরের লিপির নাম ‘হিয়েরোগ্লিফিক’। ‘হিয়েরো’ শব্দের অর্থ পবিত্র এবং ‘গ্লিফেইন’ কথার অর্থ হল খোদাই করা। হিয়েরোগ্লিফিক লিপির অনেক নমুনা উদ্ধার হয়েছে।
[গ] বাক্যের মধ্যে কোনো গ্রন্থের বা রচনার নাম উল্লেখ থাকলে সেটি একক উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে লিখিত হয়। যেমন-
অনেকদিন আগে অন্নদাশঙ্করের ‘পথে প্রবাসে’ পড়েছিলাম।
[ঘ] এছাড়াও দৃষ্টান্ত হিসেবে কোনো উক্তি বা প্রবাদ ব্যবহৃত হলে উদ্ধৃতি চিহ্নের ব্যবহার করা হয়। যেমন-
আমি তো ‘বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসি’ হয়ে গেলাম।
(১২) বর্জন-চিহ্ন [… ]
কোনো রচনার অংশবিশেষ বর্জন করা হলে সূচনাতে বর্জন চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। যেমন-
…তব ঘৃণা তারে যেন/ তৃণসম দহে।
… শাস্তির হেতু প্রধানত মহেশ।
(১৩) বন্ধনী ( ) এবং [ ]
বাক্যের কোন অংশের ব্যাখ্যার প্রয়ােজনে বন্ধনী-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। কোনো বন্ধনী চিহ্নটি ব্যবহার করা হবে তার কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। যেকোনো একটা বন্ধনী-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বন্ধনীর ভেতরের কোনো শব্দের ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমবার তৃতীয় বন্ধনী এবং তার ভেতরে প্রথম বন্ধনীর চিহ্ন ব্যবহার করা মানানসই হবে। যেমন-
অশোকের শিলালিপির (প্রস্তরে খোদিত লিপি) পাঠোদ্ধার করেছিলেন একজন পাশ্চাত্য পন্ডিত [ভিনসেন্ট স্মিথ (ব্রিটিশ ঐতিহাসিক)]।
(১৪) সংক্ষেপণ বা বিশ্রাম-চিহ্ন [ . ]
শব্দের সংক্ষেপণ বােঝাতে এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।সাধারণতঃ ইংরেজী শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপে শব্দের প্রথম বর্ণের পর এই চিহ্ন বসে।যেমন-
পি.এ (পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), পি.ও (পোস্ট অফিস) ইত্যাদি।
(১৫) পরিণতিসূচক চিহ্ন [>]
ব্যাকরণে কোনো ধ্বনি বা শব্দের রূপান্তর বা পরিণতি বোঝাতে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন-
অপিনিহিতির ফলে ‘ই’ ধ্বনি আগেই উচ্চারিত হয়। যেমন, করিয়া> কইর্যা, বলিয়া>বইল্যা ইত্যাদি।
হাত এবং কাজ কথাগুলি এইভাবে এসেছে- হস্ত>হত্থ>হাত, কার্য>কাজ্জ>কাজ।
(১৬) উৎপত্তি বা পূর্বরূপসূচক [<]
ব্যাকরণে কোনো ধ্বনি বা শব্দের উৎপত্তি বা পূর্বরূপ বোঝাতে উক্ত ধ্বনি বা শব্দের আগে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন-
কইর্যা<করিয়া, বইল্যা< বলিয়া।
হাত<হত্থ<হস্ত, কাজ<কাজ্জ<কার্য।
(১৭) ধাতুদ্যোতক চিহ্ন (√)
ক্রিয়ার মূল অবিভাজ্য অংশটি হল ধাতু। ব্যাকরণে ধাতুকে চিহ্নিত করতে এই চিহ্নের ব্যবহার করা হয়। যেমন-
√কৃ+অনীয়= করণীয়
√স্মৃ+অনীয়= স্মরণীয়
√বচ্+তব্য= বক্তব্য