বাংলা ব্যাকরণ
বাচ্য ও বাচ্য পরিবর্তন
সূচিপত্র
কর্তা, কর্ম অথবা ক্রিয়ার ভাবকে প্রাধান্য দেওয়ার যে শক্তি বাক্যের রয়েছে, তাকেই বাচ্য (Voice) বলা হয়। বাংলা ব্যাকরণের বাচ্য সংক্রান্ত ধারণাটি এসেছে সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে। ‘বাচ্য’ শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয় বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়- √বচ্+ য [ণ্যৎ]।
বাচ্যের সংজ্ঞা
অভিধান অনুসারে বাচ্য কথাটির অর্থ হল ‘বাক্যে ক্রিয়ার সহিত প্রধানভাবে অন্বিত কর্তৃ প্রভৃতি পদ’। ক্রিয়ার যে রূপভেদের মাধ্যমে বোঝা যায় যে বাক্যের ক্রিয়াপদটি কর্তা, কর্ম নাকি ক্রিয়ার ভাবের অনুসারী তাকেই বাচ্য বলা হয়। অন্যভাবে বললে, ক্রিয়াপদের দ্বারা বাক্যের কর্তা, কর্ম অথবা ক্রিয়ার ভাবের প্রাধান্য সূচিত হওয়াকেই বলে বাচ্য।
বাচ্যের প্রকারভেদে
সংস্কৃত ব্যাকরণে বাচ্য আট প্রকার। যথা- কর্তৃবাচ্য, কর্মবাচ্য, করণবাচ্য, সম্প্রদানবাচ্য, অপাদানবাচ্য, অধিকরণবাচ্য, ভাববাচ্য এবং কর্মকর্তৃবাচ্য।
কিন্তু বাংলায় বাচ্য চার প্রকার-
১) কর্তৃবাচ্য [ Active Voice ]
২) কর্মবাচ্য [ Passive Voice]
৩) ভাববাচ্য [Neuter Voice]
৪) কর্মকর্তৃবাচ্য[Quasi-Passive Voice ]
১) কর্তৃবাচ্য ( Active Voice ):- ক্রিয়ার দ্বারা বাক্যের কর্তার প্রাধান্য সূচিত হলে যে বাচ্য হয়, তাকে কর্তৃবাচ্য বলে। কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া কর্তার অনুগামী হয়।
যেমন- রাম বই পড়ে।
এখানে ‘পড়ে’ ক্রিয়াপদটি বাক্যের কর্তা ‘রাম’-এর সঙ্গে অম্বিত। বাক্যের কর্তা যদি ‘আমি’ হত তাহলে ক্রিয়াপদটি হতো ‘পড়ি’ এবং বাক্যটি হত ‘আমি বই পড়ি’। কর্তৃবাচ্যে কর্তার যে পুরুষ বা পক্ষ হয় ক্রিয়াপদেরও সেই পুরুষ বা পক্ষ হয়ে থাকে। সেইজন্য কর্তা পরিবর্তন হলে ক্রিয়ার রূপও পরিবর্তিত হয়।
২) কর্মবাচ্য [Passive Voice]:- ক্রিয়ার দ্বারা বাক্যে কর্মের প্রাধান্য সূচিত হলে যে বাচ্য হয় তাকে কর্মবাচ্য বলে। কর্মবাচ্যের ক্রিয়া বাক্যের কর্মের অনুগামী হয়।
যেমন- ‘রামের দ্বারা বই পড়া হয়’।
এখানে ‘পড়া হয়’ ক্রিয়াপদটি বাক্যের কর্ম ‘বই’কে বোঝাচ্ছে। এখন বাক্যের কর্তা হলো রাম এবং রামের জায়গায় যদি শ্যাম, যদু, মধু ইত্যাদি লিখি তাও কিন্তু ক্রিয়াপদ ওই একই থাকবে। [তখন বাক্যটি হবে শ্যামের দ্বারা/ যদুর দ্বারা/ মধুর দ্বারা বই পড়া হয়।] কারণ, এটি কর্মবাচ্য। এখানে কর্মই আসল, বাক্যের ক্রিয়া এখানে কর্মের অনুসারী। যদি কর্মবাচক পদটি পরিবর্তন করি তবেই ক্রিয়াপদের পরিবর্তন হবে। যেমন- ‘রামের দ্বারা ভাত খাওয়া হয়’। এই বাক্যের কর্ম হল ‘ভাত’ এবং ক্রিয়াপদ ‘খাওয়া হয়’।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন, কেবলমাত্র সকর্মক ক্রিয়ার কর্মবাচ্য সম্ভব, অকর্মক ক্রিয়ার কর্মবাচ্য হয় না।
৩) ভাববাচ্য [Neuter Voice]:- ক্রিয়ার দ্বারা বাক্যের কর্তা বা কর্মের কারো প্রাধান্য সূচিত না হয়ে যেখানে ক্রিয়ার (বা, ভাবের) প্রাধান্য সূচিত হয়, সেখানে যে বাচ্য হয়, তাকে ভাববাচ্য বলা হয়।
যেমন- এখন পড়া চলছে।
বাড়িতে সকলের খাওয়া হয়ে গেছে।
এখনো লেখা হয়নি।
উপরের তিনটি বাক্যে ক্রিয়াপদগুলিই প্রাধান্য পেয়েছে। এই বাক্যগুলিতে কর্তা বা কর্ম প্রধান নয়, ক্রিয়ার ভাবই প্রধান। আরো একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, ভাববাচ্যে যদি কর্তা থাকে তবে তার সঙ্গে সাধারণত ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন, দ্বিতীয় বাক্যটিতে ‘সকলের’ পদটি।
৪) কর্মকর্তৃবাচ্য [Quasi-Passive Voice ]:- যে বাচ্যে কর্তা উহ্য থাকে, কর্ম কর্তার ভূমিকা পালন করে এবং বাক্যের ক্রিয়া সেই কর্তারূপী কর্মের অনুসারী হয় তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলা হয়। সহজ ভাষায় বললে, কর্মকর্তৃবাচ্য আসলে কর্তাহীন বাচ্য কিন্তু কর্ম কর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় অর্থাৎ কর্মকেই কর্তা বলে মনে হয়।
যেমন- সারাক্ষণ বাঁশি বাজে।
ভাদ্রমাসের আকাশে অনেক ঘুড়ি উড়ে।
সন্ধ্যা বেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে।
উপরের বাক্যগুলিতে ঘুড়ি, বাঁশি, প্রদীপ প্রভৃতি হলো কর্ম। কারণ, বাঁশি নিজে নিজে বাজে না, ঘুড়ি নিজে নিজে আকাশে উড়ে না, প্রদীপও নিজে নিজে জ্বলে না। এগুলি আসলে কর্ম কিন্তু এরা কর্তার ভূমিকা পালন করছে; অর্থাৎ, মনে হচ্ছে যেন বাঁশি নিজে থেকেই বাজছে, ঘুড়ি নিজেই উড়ছে বা প্রদীপও নিজে থেকেই জ্বলছে। তাই এগুলি কর্মকর্তৃবাচ্য।
বাচ্য পরিবর্তন
ক্রিয়াই হল বাচ্যের নিয়ন্তা। আগেই বলা হয়েছে- যে ধরণের বাচ্য, ক্রিয়াও সেইরূপ হয়। বাচ্য পরিবর্তনের সময় এই দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য সকল বাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু অন্যান্য বাচ্যগুলির পারস্পরিক রূপান্তর সবসময় সম্ভব হয় না। তাহলে প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক অন্যান্য বাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তর। আবারো বলছি, কর্তৃবাচ্যে রূপান্তর করার অর্থই হল ক্রিয়াটিকে কর্তার অনুগামি হতে হবে।
কর্মবাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে
রামের দ্বারা একটি চিঠি লিখিত হচ্ছে। (কর্ম)
রাম একটি চিঠি লিখছে। (কর্তৃ)
কর্মবাচ্যে ক্রিয়াপদ কর্মবাচক পদটির অনুসারী হয়। যেমন, উপরের উদাহরণে ‘লিখিত হচ্ছে’ ক্রিয়াটি ‘চিঠি’কে (কর্ম) বোঝাচ্ছে। কর্মবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরিত করতে হলে ক্রিয়াপদটিকে কর্তার অনুগামী করতে হয় এবং ‘হ’ ধাতুজাত ক্রিয়াপদটি লোপ পায়। কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্যে রূপান্তরিত করতে হলে এর বিপরীত নিয়মে করতে হবে।
ভাববাচ্য থেকে কর্তৃবচ্যে
রামের ঘুমানো হচ্ছে। (ভাব)
রাম ঘুমোচ্ছে। (কর্তৃ)
ভাববাচ্যে ক্রিয়ার ভাবটির প্রাধান্য থাকে। যেমন, উপরের উদাহরণে ‘হচ্ছে’ ক্রিয়াপদটি ‘ঘুমানো’কে বোঝাচ্ছে। (কী হচ্ছে= ঘুমানো) এই ‘ঘুমানো’ পদটি ক্রিয়ার ভাব। ভাবটির প্রাধান্য লোপ করে কর্তার উপর ক্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেই কর্তৃবাচ্যে পরিণত হবে। আবার, কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে রূপান্তর করতে হলে এর বিপরীত নিয়মে করতে হবে।
কর্মকর্তৃবাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে
শাঁখ বাজছে। (কর্মকর্তৃবাচ্য)
কেউ শাঁখ বাজাচ্ছে। (কর্তৃ)
কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা উহ্য থাকে এবং কর্ম কর্তার ভূমিকা পালন করে। কোনো অনির্দেশক সর্বনামকে (যেমন- কেউ/ কেহ) কর্তা হিসেবে আমদানি করলে কর্মকর্তৃবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরিত করা যায়। কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মকর্তৃবাচ্যে রূপান্তর করতে হলে (সাধারণত করতে হয় না) এর বিপরীত নিয়মে করতে হবে।
কর্মকর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে রূপান্তর
সাধারণত কর্মকর্তৃবাচ্যকে ভাববাচ্যে রূপান্তরিত করা হয় না। তবে, ক্ষেত্রবিশেষে কর্মকর্তৃবাচ্যকে ভাববাচ্যে রূপান্তর করা যেতেও পারে। যেমন-
প্রদীপ জ্বলছে। (কর্মকর্তৃ)
প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে। (ভাববাচ্য)
কর্মবাচ্য থেকে ভাববাচ্য
ব্যাকরণের নিয়মে কর্মবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে বা ভাববাচ্য থেকে কর্মবাচ্যে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। কেন নয়? কারণ, উভয় প্রকার বাচ্যে একটি করে ‘হ’ ধাতুজাত ক্রিয়া (Be verb) থাকে। যেমন-
রাহুলের দ্বারা গীতা পঠিত হচ্ছে। (কর্মবাচ্য)
তানিয়ার খাওয়া হয়েছে। (ভাববাচ্য)
কর্মবাচ্যে ‘হ’ ধাতুজাত ক্রিয়াটি মূল ক্রিয়াপদের সঙ্গে মিশে যৌগিক ক্রিয়ার মতো আচরণ করে এবং সেই যৌগিক ক্রিয়াটি কর্মকে সূচিত করে। ভাববাচ্যে কর্মবাচক পদ থাকে না, ‘হ’ ধাতুজাত ক্রিয়াটি মূল ক্রিয়ার ভাবকে তুলে ধরে। তার মানে, যদি কর্ম থাকে তাহলে ক্রিয়ার ভাবটির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে না; অন্যভাবে বললে, কর্মবাচ্যেকে ভাববাচ্যে করা যাবে না।
সবশেষে বলব, ব্যাকরণ শিখতে হলে নিয়ম মুখস্ত না করে অনুশীলন করা দরকার। যত বেশি অনুশীলন করা হবে, ব্যাকরণের ভিতটা ততই মজবুত হবে।