দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্য বাঙালির বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস অধ্যায়টি বেশ বড় এবং এতোই তথ্যবহুল যে প্রতি লাইন থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য এই ভিডিওটি বানানো হল। ভিডিওটিতে সমগ্র অধ্যায়ের সব তথ্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হল। ভিডিওটি দেখলে বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা অধ্যায় থেকে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে।
বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা || Bangalir Bigyan Chorcha
সূচিপত্র
আগেই বলা হয়েছে যে আলোচ্য অধ্যায়টি বেশ বড়। তাই সমগ্র আলোচনাটিকে পাঁচটি পর্বে ভাগ করা হল-
১) বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার
২) চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালির অবদান
৩) বাঙালির কারিগরি বিদ্যা
৪) বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা
৫) বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা
বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার
আমাদের দেশে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে। বাঙালির বিজ্ঞান সাধনার প্রথম পর্বে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেগুলি হল-
১) বোটানিক্যাল গার্ডেন- ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজি অফিসার রবার্ট কিড-এর উদ্যোগে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের দেশীয় মশলাপাতি এবং মূল্যবান কাঠের জোগান দেওয়ার জন্যেই এই বাগান গড়ে তোলা হয়েছিল।
কিডস সাহেবের পর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপার হয়ে এসেছিলেন ডঃ উইলিয়াম রকসবার্গ। তাকে ভারতীয় উদ্ভিদ বিদ্যার জনক নামে অভিহিত করা হয়।
১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় “রেকর্ড অফ দ্য বোটানিক্যাল সার্ভে অফ দি বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া”।
২) এশিয়াটিক সোসাইটি- উপনিবেশিক ভারতে প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। এই সোসাইটির প্রাণপুরুষ ছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স।
৩) শ্রীরামপুর মিশন- এদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার জন্যই ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ ছিলেন উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড এবং জোশুয়া মার্শম্যান। শ্রীরামপুর মিশনের হাত ধরেই বাংলা গদ্যের পথচলা শুরু হয়েছিল। বাঙালির বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে শ্রীরামপুর মিশনের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই মিশনের উদ্যোগেই পঞ্চানন কর্মকার বাংলা হরফ নির্মাণ করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ উইলিয়াম কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি রচনা করেছিলেন প্রথম বাংলা বিশ্বকোষজাতীয় রচনা ‘বিদ্যাহারাবলী’।
৪) স্কুল বুক সোসাইটি- স্কুল পাঠ্যপুস্তক এর ঘাটতি মেটানোর উদ্দেশ্যে আঠারোশ সতেরো খ্রিস্টাব্দে স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মূলত বিদ্যোৎসাহী রাজন্যবর্গ এবং মহানুভব ইংরেজদের অর্থসাহায্যে এই সোসাইটি পরিচালিত হত। ১৮২১ সাল পর্যন্ত সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছিল ১,২৬,৪৬৪।
৫) হিন্দু কলেজ- সুশৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডেভিড হেয়ার প্রমুখদের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় হিন্দু কলেজের পথচলা। ১৮৫৫ সালে এই কলেজের নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং ২০১০ সালে এটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালির অবদান
এই পর্বে আমরা কয়েকজন স্বনামধন্য বাঙালি চিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানীর কথা তুলে ধরব।
নীলরতন সরকার (১৮৬১-১৯৪৩)- প্রথিতযশা এই চিকিৎসক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। চিকিৎসক হিসেবে তিনি তাঁর সমকালের অন্যান্য চিকিৎসকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা হল ‘সিরোসিস অফ লিভার ইন চিলড্রেন’।
তিনি ডাক্তার সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারি সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও আর জি কর মেডিকেল কলেজে প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর অপরিসীম অবদান ছিল। তিনি দীর্ঘ বারো বছর ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এর মুখপাত্র সম্পাদনা করেছিলেন।
ডাক্তার নীলরতন সরকার যেমন একজন সুচিকিৎসক ছিলেন তেমনি তিনি একজন মহৎ শিল্পোদ্যোগী ছিলেন। ভারতে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দূষণমুক্ত ট্যানারি এবং সার ও সাবানের কারখানা স্থাপন করেছিলেন। রাঙ্গামাটি চা কোম্পানি গঠনে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দির, বিশ্বভারতী ও ভারতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি ছিলেন। তারই প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল বেঙ্গল টেকনিক্যাল স্কুল এবং যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ক্যালকাটা মেডিকেল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি ছিলেন।
রাধাগোবিন্দ কর (১৮৫২-১৯১৮)- দেশীয় ভাষায় চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার উদ্দেশ্যে তিনি বেলগাছিয়া এলবার্ট ভিক্টর কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করেছিলেন। তাঁর মৃত্যর পর এই হাসপাতালের নাম হয় আর জি কর মেডিকেল কলেজ।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (১৮৬১-১৯২৩)- ভারতের প্রথম বিদেশি ডিগ্রিধারী মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের প্রথম ছাত্রী।
এই পর্বে আমরা মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪), লালমাধব মুখোপাধ্যায় (১৮৪১-?), বনবিহারী মুখোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৬৫), উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী (১৮৭৩-১৯৪৬), সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারি (১৮৬৫-১৯২১), চুনীলাল বসু (১৮৬১-১৯৩০), বিধানচন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯৬২), গিরীন্দ্রশেখর বসু (১৮৮৭- ১৯৫৩) প্রমুখ চিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানীর পরিচয় লাভ করবো।
বাঙালির প্রযুক্তি ও কারিগরি বিদ্যা
বর্তমানে কারিগরিবিদ্যা হল একটি স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয়। তবে আমরা যে কালপর্ব নিয়ে আলোচনা করছি তখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। এই সময় কয়েকজন কৃতি বাঙালি আপন সাধনার বলে কিছু অত্যাশ্চর্য জিনিস তৈরি করে ফেলেছিলেন। আলোচ্য পর্বে আমরা তাদের কথাই তুলে ধরব।
গোলকচন্দ্র নন্দী– কারিগরি দক্ষতার নিরিখে গোলকচন্দ্রকে ভারতের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার বলা চলে। তিনিই আমাদের দেশে প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন নির্মাণ করেছিলেন।
শিবচন্দ্র নন্দী– প্রথম জীবনে টাঁকশালের কর্মচারী শিবচন্দ্র ছিলেন ভারতের প্রথম ইলেকট্রিক্যাল এবং টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০ মাইল দুর্গম পথে টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল।
সীতানাথ ঘোষ- স্বভাব-বিজ্ঞানী সীতানাথ ঘোষ ছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁর আবিষ্কারের তালিকায় রয়েছে যন্ত্রচালিত লাঙ্গল, গম ভাঙানোর যন্ত্র, কলম ও মুদ্রা যন্ত্রের জন্য বিভিন্ন রকম কালী ইত্যাদি।
মহেন্দ্রচন্দ্র নন্দী (১৮৫৫- ১৯৩২)- স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মহেন্দ্র চন্দ্র দেশলাইসহ বেশ কিছু ক্ষুদ্রশিল্প স্থাপন করেছিলেন এবং নির্যাতিতা মহিলাদের শিক্ষার মাধ্যমে স্বনির্ভর করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাজকৃষ্ণ কর্মকার– সুশিক্ষিত কারিগর এবং প্রযুক্তিবিদ রাজকৃষ্ণ বহু গুণের গুণী ছিলেন। গোলাবারুদ এবং বন্দুক তৈরীর ব্যাপারে যেমন তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল তেমনি টাঁকশালের কলকব্জাও তাঁর নখদর্পণে ছিল। শুধু তাই নয়, বাষ্পীয় বয়লার নির্মাণেও তিনি বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তিনি নেপালের টাঁকশাল এবং গোলাবারুদ কারখানার উন্নতি সাধন করেছিলেন। কাবুলের আমিরের ডাকে সেখানে গিয়ে তিনি রেললাইন পাতার কাজও করেছিলেন।
কালিদাস শীল– দে শীল এন্ড কোম্পানির কর্নধার কালিদাস শীল ছিলেন বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির কারিগর। বাতি ছাড়াও এই কোম্পানি ফ্যান, মোটরচালিত সেলাইমেশিন তৈরি করত।
নীলমণি মিত্র (১৮২৮- ১৮৯৪) – রুড়কি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম দেশীয় ছাত্র নীলমণি মিত্র একজন বিখ্যাত বাস্তুবিদ ছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩- ১৯১৫)- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে উপেন্দ্রকিশোর স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মুদ্রণশিল্পে তার মৌলিক গবেষণার কারণে। তিনি ভারতবর্ষে হাফটোন ব্লকের প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলে ও তাঁর স্বীকৃতি রয়েছে
সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)- উপেন্দ্রকিশোরের যোগ্য পুত্র সুকুমার রায় আলোকচিত্র এবং মুদ্রণপ্রযুক্তিতে তাঁর মৌলিক ভাবনার জন্য বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলেন।
হেমেন্দ্রমোহন বসু (১৮৬৬-১৯১৯)- বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোগী হেমেন্দ্রমোহন বসু মোটরগাড়ি, বাইসাইকেল, টর্চলাইট এবং সুগন্ধি তেলের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল কলের গানের রেকর্ড তৈরির কারখানা স্থাপন।
রসিকলাল দত্ত – পেশায় চিকিৎসক রসিকলাল দত্ত রাসায়নিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডক্টর অফ সাইন্স উপাধি পেয়েছিলেন।
বিপিনবিহারী দাস – সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে মোটরগাড়ি নির্মাণ করে ছিলেন ‘কলকাতার বিশ্বকর্মা’ নামে খ্যাত বিপিনবিহারী দাস। তাঁর তৈরি গাড়িটির নামও ছিল ‘স্বদেশী’।
প্রমথনাথ বসু (১৮৫৫-১৯৩৫)- বিশ শতকের সেরা বাঙালি ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী প্রমথনাথ মধ্যপ্রদেশের ধুল্লি ও রাজাহারা লৌহখনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে ভিলাই কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। তিনিই জামসেদজি টাটাকে ঝাড়খণ্ডের ময়ূরভঞ্জ জেলায় লৌহখনির সন্ধান দিয়েছিলেন বলে আজ সেখানে ইস্পাতসাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। তিনি আসাম, রাণীগঞ্জ এবং দার্জিলিং-এ কয়লার সন্ধান দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থটি হল ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’।
পিএম বাগচি এন্ড কোম্পানি– 1883 খ্রিস্টাব্দে কিশোরী মোহন বাগচী এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। লেখার কালি, সুগন্ধি ও প্রসাধন সামগ্রী, রাবার স্ট্যাম্প, পঞ্জিকা ছাপাখানা, কাঠের ব্লক ও ওষুধ তৈরিতে বিশেষ অবদানের জন্য বাঙালি প্রযুক্তিবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই কোম্পানিটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা
আলোচ্য অংশে কয়েকজন স্বনামধন্য বাঙালি বিজ্ঞানীর অবদানের কথা তুলে ধরা হল।
জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭)- বেতার তরঙ্গ আবিষ্কার করে জগদীশ চন্দ্র বসু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অব সায়েন্স উপাধি লাভ করেন। তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে গাছেরও চেতনা আছে। ১৯১৭ সালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার জন্য তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দির স্থাপন করেছিলেন।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪)- প্রেসিডেন্সি কলেজের এই অধ্যাপক একাধারে একজন গবেষক এবং মহৎ শিল্পোদ্যোগী ছিলেন। তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার মারকিউরাস নাইট্রাইট। বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস তাঁরই প্রতিষ্ঠা। তার আত্মজীবনীর নাম ‘লাইফ এন্ড এক্সপেরিয়েন্স অফ এ বেঙ্গলি কেমিস্ট’।
মেঘনাথ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬) – যে কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে মেঘনাথ সাহা অন্যতম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার এই অধ্যাপক দামোদর উপত্যকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এই মহান বিজ্ঞানীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ভারতীয় বর্ষপঞ্জির সংস্কার।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪)- সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্বের জনক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আবার, একই সঙ্গে তিনি একজন সাহিত্যিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ “বিশ্বপরিচয়” তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।
দেবেন্দ্রমোহন বসু (১৮৮৫-১৯৭৫)- জগদীশচন্দ্র বসুর স্নেহধন্য এই পদার্থবিজ্ঞানী চৌম্বকক্ষেত্রের উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রিয়দারঞ্জন রায় (১৮৮৮-১৯৮২)- তার পছন্দের বিষয় ছিল অজৈব রসায়ন। বাংলা ভাষায় রচিত তার বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থটির নাম “অতিকায় অনুর বিচিত্র কাহিনী”। এছাড়াও তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস” গ্রন্থটি নতুন করে সম্পাদনা করেছিলেন।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৩-১৯৮৩)- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অন্যতম ছাত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথের গবেষণার বিষয় ছিল কোলয়েডের মধ্যে তড়িৎ উদ্ভবের ক্রিয়া।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪- ১৯২৪)- বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একজন খ্যাতনামা গণিতবিদ ছিলেন। এর পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা, সংস্কৃত ও পালি ভাষা-সাহিত্য এবং আইনবিদ্যায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল।
ইন্দুমাধব মল্লিক (১৮৬৯- ১৯১৭)- বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইন্দুমাধব ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ইকমিক কুকার উদ্ভাবন করেন। এদেশে অটোভ্যাকসিন পদ্ধতি তিনি প্রথম চালু করেন।
শিশিরকুমার মিত্র (১৮৯০- ১৯৬৩)- বিশিষ্ট বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী শিশির কুমার মিত্রের গবেষণার বিষয় ছিল রেডিও ফিজিক্স। তিনি ম্যাডাম ক্যুরির গবেষণাগারে কাজ করার বিরল সুযোগের অধিকারী। তাঁর গ্রন্থটির নাম দি আপার অ্যাটমোস্ফিয়ার।
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩- ১৯৭২)- আধুনিক ভারতীয় রাশিবিজ্ঞানের জনক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন।
নীলরতন ধর (১৮৯২- ১৯৮৬)- ভৌত রসায়ন ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত নীলরতন ধর ১৯৩৮, ১৯৪৭ এবং ১৯৫২ সালে নোবেল পুরস্কার কমিটিতে বিচারকের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তাঁর মৌলিক গবেষনাপত্রের সংখ্য ছয়শতাধিক।
ঠাকুর পরিবারের বিজ্ঞানচর্চা
এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের প্রথম যুগে ঠাকুর পরিবারের অবদান ছিল অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর একজন বিজ্ঞানমনস্ক সমাজসংস্কারক ছিলেন। তৎকালীন বঙ্গদেশে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একজন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসাবে খ্যাত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় বিষয় ছিল জ্যোতির্বিদ্যা। এছাড়াও তিনি ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের জৈষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ গণিত বিশারদ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ কিছুকাল চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন এবং “প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের স্থূল মর্ম” নামে একটি বই লিখেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফ্রেনোলজি বা শিরোমিতিবিদ্যার চর্চা করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর “পৃথিবী” গ্রন্থটিতে তার বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক, ভারতী, সাধনা প্রভৃতি পত্রিকাগুলিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিশ্বপরিচয় গ্রন্থটিতে কবিরে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা
কথায় বলে, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। মাতৃভাষায় রচিত যেকোনো রচনা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়। বাংলা ভাষাতেও বৈজ্ঞানিক গ্রন্থের সংখ্যা কম নয়। এই পর্বে আমরা তেমনি কয়েকটি গ্রন্থ এবং তাদের গ্রন্থকারের পরিচয় সংক্ষেপে জেনে নেব।
অক্ষয় কুমার দত্তের লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ গুলি হল ‘ভূগোল’, ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ এবং ‘পদার্থবিদ্যা’।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর গ্রন্থগুলি হল ‘প্রকৃতি’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’, ‘পদার্থবিদ্যা’, ‘বিচিত্র জগৎ’, ‘ভূগোল’, ‘কর্মকথা’, ‘জগৎকথা’ ইত্যাদি।
জগদানন্দ রায়ের বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থগুলি হল ‘গ্রহ-নক্ষত্র’, ‘প্রাকৃতিকি’, ‘বৈজ্ঞানিকি’, ‘পোকামাকড়’, ‘জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার’, ‘বাংলার পাখি’, ‘শব্দ’ ইত্যাদি।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের বৈজ্ঞানিক রচনাগুলি হল ‘আধুনিক আবিষ্কার’, ‘বাংলার মাকড়সা’, ‘করে দেখ’, ‘আমরা এবং আনবিক বোমা’, ‘মহাশূন্যের রহস্য’, ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’, ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’, ‘বাংলার গাছপালা’, ‘পশুপাখি কীটপতঙ্গ’, ‘বিজ্ঞানের আবিষ্কার’, ‘বিজ্ঞান অমনিবাস’, ‘জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা খবর’, ‘মানবকল্যাণে পারমাণবিক শক্তি’ ইত্যাদি।
চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল ‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাহিনী’, ‘নব্যবিজ্ঞান’, ‘বাঙালির খাদ্য’, ‘বিশ্বের উপাদান’, ‘তড়িতের অভ্যুত্থান’, ‘ব্যাধির পরাজয়’, ‘পদার্থবিদ্যার নবযুগ’ ইত্যাদি।
এই তালিকায় রয়েছে মৃত্যুঞ্জয় প্রসাদ গুহ রচিত ‘আকাশ ও পৃথিবী’, জিতেন্দ্রনাথ গুহ রচিত ‘মহাকাশ পেরিয়ে’, এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় ও শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পরমাণু জিজ্ঞাসা’, ডঃ অনাদি দাঁ রচিত ‘ইলেকট্রনিক্স’ ইত্যাদি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থগুলি।
বড় প্রশ্ন (মান-৫)
- প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ
- উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী
- চিকিৎসক ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়
- কাদম্বিনী বসু (গঙ্গোপাধ্যায়)
- চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাঙালির অবদান
- জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিজ্ঞানচর্চা
- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
- জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান
- সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান
- মেঘনাদ সাহার অবদান
এমসিকিউ টেস্ট
এই অধ্যায় থেকে এমসিকিউ টেস্টের জন্য এখানে ক্লিক করো। মূল বইটি পড়া থাকলে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে। বিকল্প হিসেবে উপরের ভিডিওটি দেখতে পারো।