ভাব সম্মিলনঃ বিদ্যাপতি

ভাব সম্মিলনঃ বিদ্যাপতি|| Bhab Sammilan by Vidyapati

পঞ্চদশ শতকের মৈথিলী কবি বিদ্যাপতি। ব্রজবুলি ভাষায় লিখিত তাঁর বৈষ্ণব পদগুলি বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদের রসাস্বাদন করতেন। আলোচ্য পদটি ভাবসম্মেলন বা ভাবোল্লাস পর্যায়ের একটি জনপ্রিয় পদ।

বিদ্যাপতির লেখা ভাব সম্মিলন
বিদ্যাপতির লেখা ভাব সম্মিলন

ভাবসম্মেলন বা ভাবোল্লাস:

রাধাকৃষ্ণের প্রেমমাহাত্ম্য সূচক পদকে বলা হয় বৈষ্ণব পদাবলি। বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে পদ রচনা করেছেন। এই পর্যায়গুলি হল পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, কলহান্তরিতা, মাথুর, ভাবসম্মিলন প্রভৃতি।

পূর্বরাগ পর্যায়ে প্রেমের সূচনা। এরপর যথাক্রমে অনুরাগ এবং অভিসার পর্যায়ে সেই সম্পর্ক চরম উচ্চতায় পৌঁছায়। কিন্তু কংসকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলে তাদের বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কৃষ্ণকে হারিয়ে রাধার জীবনে যে দুঃখের ছায়া নেমে এসেছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় মাথুর পর্যায়ের পদে। কিন্তু মানুষ একটানা দুঃখ সহ্য করতে পারে না, যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কোনো না কোনো উপায় সে খুঁজে বার করে। রাধাও তাই করেছিল।

বাস্তবে কৃষ্ণ নেই, কিন্তু কৃষ্ণের কল্পনা করতে তো দোষ নেই? কৃষ্ণ তখন মথুরায়, আর রাধা কল্পনার ভাব বৃন্দাবনে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হচ্ছিল। কল্পনার রাজ্যে প্রিয়মিলনে না আছে কোনো বাধা, না আছে বিচ্ছেদের ভয়। রাধাকৃষ্ণ প্রেমের এই পর্যায়কে ভাব সম্মিলন বা ভাবোল্লাস বলা হয়। ভাব সম্মিলন বা ভাবোল্লাস পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি।

ভাব সম্মিলন:শব্দার্থ সহ গদ্যরূপ

কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।

কী বলব রে সখি আমার আনন্দের কোনো সীমা (ওর) নেই! দীর্ঘকাল পরে শ্রীকৃষ্ণ (মাধব) আমার ঘরে (মন্দিরে) এসেছেন।

পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।
পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।

কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে চলে যাবার পর চাঁদ যেন রাধাকে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছে। কারণ, প্রতিরাতে চাঁদকে দেখে রাধার কৃষ্ণের কথা মনে পড়ে যেত। এইজন্য রাধার চোখে সুধাকর বা চাঁদ হলো পাপী। রাধা বলেছে, নিষ্ঠুর চাঁদ (পাপ সুধাকর) তাকে যত দুঃখ দিয়েছে, প্রিয় কৃষ্ণের মুখ দেখে (পিয়া-মুখ-দরশনে) তার ততটাই সুখ হল (ভেল)।

আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।
তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।

আঁচল ভরে (আঁচর ভরিয়া) যদি মহাশ্বৈর্য বা বিপুল ধনসম্পদ (মহানিধি) পাই, তবু আমি (তব হাম) প্রিয়কে (পিয়া) দূর দেশে পাঠাবো না (না পাঠাই)।

শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।

কৃষ্ণ রাধার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তার জীবনে কৃষ্ণ যে কতখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে, সে কথা বোঝাতেই রাধা বলেছে- প্রিয় (পিয়া) কৃষ্ণ হল শীতের ওড়না বা উত্তরীয় (শীতের ওঢ়নী), গ্রীষ্মের বাতাস (গীরিষির বা), বর্ষার ছাতা (বরিষার ছত্র) এবং নদী পারাপারের নৌকা (দরিয়ার না)।

ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি।
সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।

মধ্যযুগের কবিগণ কবিতার শেষ চরণে আত্মপরিচয় জ্ঞাপক কোনো শ্লোক বা পংক্তি যোগ করতেন। তাকে বলা হত ভণিতা। আলোচ্য ‘ভাব সম্মেলন’ পদের ভণিতায় বিদ্যাপতি বলছেন (ভণয়ে বিদ্যাপতি), শোনো হে বরণীয়া নারী, ভালো মানুষের দুঃখ (সুজনক দুখ) মাত্র দু’চার দিনের (দিবস দুই-চারি)।

ভাব সম্মিলন: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

ভাব সম্মিলন কবিতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া হল। এগুলি ছাড়াও যদি অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর চাও তাহলে যোগাযোগ ফর্মের মাধ্যমে জানাবে। যদি প্রশ্নটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে যত শীঘ্র সম্ভব উত্তর দেওয়া হবে।

প্রশ্ন: ভাব সম্মিলন বলতে কী বোঝো? এই প্রসঙ্গে আলোচ্য কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো। ২+৩

উত্তরঃ ‘ভাব সম্মিলন’ কথার সাধারণ অর্থ হল ভাবের জগতে মিলন। তবে বৈষ্ণব সাহিত্যে এই পদযুগলের বিশেষ অর্থ রয়েছে। কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর বিরহীনি রাধা কল্পিত ‘ভাব বৃন্দাবনে’ কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমবৈচিত্র্যের এই পর্যায়েকে বলা হয় ভাব সম্মিলন বা ভাবোল্লাস।

আলোচ্য পদটির শুরুতেই রাধা তার আনন্দের কথা প্রকাশ করেছে। কারণ, দীর্ঘকাল পর মাধব তার গৃহে আসছেন। এতদিন ধরে চাঁদ তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তবে, প্রিয় কৃষ্ণের মুখ দেখে রাধা ততোধিক সুখ পেয়েছে। রাধার কথা শুনে মনে হতে পারে কৃষ্ণ বৃন্দাবনে ফিরে এসেছেন, কিন্তু বাস্তবে কৃষ্ণ তখনও মথুরায় ছিলেন। অর্থাৎ তাদের এই মিলন একান্তই ভাবের জগতে।

কৃষ্ণকে ফিরে পেয়ে রাধা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে, তার আঁচল ভরে বিপুল ধনসম্পদ দেওয়া হলেও সে তার প্রিয়কে কখনোই দূর দেশে পাঠাবে না, কারণ কৃষ্ণই তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। কৃষ্ণের এই প্রত্যাবর্তন ঘটেছে রাধার ভাবলোকে, বাস্তবে নয়।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, ভাবের জগতে রাধাকৃষ্ণের মিলনই এ পদের মূল উপজীব্য। সুতরাং আলোচ্য পদের নামকরণ বিষয়ানুগ হয়েছে, একথা বলা যায়।

সর্বোপরি, এই পথটি ভাব সম্মিলন পর্যায়ের একটি উৎকৃষ্ট পদ। সেই হিসেবেও পদটি সার্থকনামা বলা যেতে পারে। (শব্দসংখ্যা ১৬৫)

প্রশ্ন: “আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।”- আঁচর’ এবং ‘মহানিধি’ শব্দগুলির অর্থ কী? কোন প্রসঙ্গে এবং কেন বক্তা এ কথা বলেছে? ২+৩

উত্তরঃ ‘মৈথিলি কোকিল’ বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত পংক্তিটি নেওয়া হয়েছে। ‘আঁচর’ শব্দের অর্থ হল আঁচল এবং ‘মহানিধি’ শব্দের অর্থ মহাশ্বৈর্য বা বিপুল ধনসম্পদ।

কংসকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ মথুরা চলে যায় এবং রাধার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্য রাধা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু মিলন তো দূরে থাক, কৃষ্ণের মুখ দর্শন করারও উপায় ছিল না। এইভাবে দীর্ঘ বিরহ যন্ত্রণা ভোগ করার পর রাধা এক অভিনব পন্থায় কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়। নিজের মানস বৃন্দাবনে সে কৃষ্ণকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে লাভ করে। ভাবের জগতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাধা এই পণ করে যে, সে যদি আঁচল ভরে মহাশ্বৈর্য পায়, তবুও তার প্রিয়কে দূর দেশে পাঠাবে না।

রাধা ছিল প্রকৃত অর্থেই ‘কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী’। সে তার সমস্ত সত্তা কৃষ্ণে সমর্পণ করে বসে আছে। কৃষ্ণ তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। রাধার জীবনে কৃষ্ণ হল শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা এবং নদী পারাপারের নৌকা। আর এইজন্যই রাধা তার প্রিয় সখাকে দূরদেশে পাঠাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। (শব্দসংখ্যা ১৫৪)

প্রশ্ন: “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।”- ‘পাপ সুধাকর’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ কী? সে কীভাবে বক্তাকে দুঃখ দিয়েছিল? ২+৩

উত্তরঃ ‘পাপ সুধাকর’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল পাপী বা নিষ্ঠুর চাঁদ। কবিকল্পনায় চাঁদ সৌন্দর্যের প্রতীক, শুচিতার প্রতীক। চাঁদকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কত যে কবিতা রচিত হয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু ভাবোল্লাস পর্যায়ে বিদ্যাপতির রাধা সেই চাঁদকে নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করেছে।

চাঁদের সঙ্গে শ্রীরাধার বৈরিতা হওয়ার কথা নয়। বস্তুত, রাধাকৃষ্ণের বহু শুভক্ষণের সাক্ষী থেকেছে চাঁদ। কিন্তু কৃষ্ণের মথুরাগমনের পর চাঁদকে রাধার নিষ্ঠুর বলেই মনে হয়েছে। কৃষ্ণের বিরহে যখন রাধার ভুবনময় অন্ধকার, তখন চন্দ্রালোকিত শুভ্র জ্যোৎস্না রাধার বিরহ বেদনা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলত। যেহেতু কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের কোনো উপায় ছিল না, তাই ‘চাঁদের হাসি’ রাধার কাছে অট্টহাস্য বলে মনে হতো।

আবার, রাধা যে কৃষ্ণকে ভুলে থাকবে তারও উপায় ছিল না। কারণ আকাশের চাঁদকে দেখে রাধার আরেক কৃষ্ণচন্দ্রের কথা মনে পড়ে যেত। কিন্তু কৃষ্ণ তখন মথুরায়, তাই মিলনের কোনো উপায় ছিল না। এইভাবে প্রবাসী ‘পিয়া’র প্রতি মিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলে চাঁদ রাধাকে দুঃখ দিত। এইজন্য কৃষ্ণের সঙ্গে ভাবোল্লাসে মত্ত রাধা চাঁদকে ‘পাপ সুধাকর’ বা নিষ্ঠুর চাঁদ বলেছে। (শব্দসংখ্যা ১৫২)

দ্বিতীয় সেমিস্টারের অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তরঃ 

error: Content is protected !!