জয় গোস্বামীর নুন

নুন: জয় গোস্বামী|| Nun by Joy Goswami

আধুনিক প্রজন্মের খ্যাতনামা কবি জয় গোস্বামীর নুন কবিতাটি কোনো সাধারণ কবিতা নয়, বরং বলা যেতে পারে, কবিতাটি আসলে একটি খোলা চিঠি। আর্থিকভাবে দুর্বল, সমাজের সবথেকে নিচুতলার মানুষ, যাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা, তাদের হয়েই কবি লেখনী ধারণ করেছেন। শুধু তাই নয়, আলোচ্য কবিতাতে কবি উত্তম পুরুষের জবানিতে তাদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেছেন।

জয় গোস্বামীর নুন কবিতা
জয় গোস্বামীর নুন কবিতা

নুন: কবিতার সরলার্থ

আমরা তো অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।

আমরা তো অল্পতেই খুশি; দুঃখ করে লাভ নেই। সাধারণ ভাতকাপড়ে (অর্থাৎ সাধারণ খাবার এবং পোশাক পরেই) আমাদের দিন চলে যায়।

চলে যায় দিন আমাদের অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে।

দিন চলে যায় ঠিকই কিন্তু অসুখবিসুখ হলে ধারদেনা করতে হয়। অভাব যাদের নিত্য সঙ্গী, নেশা তাদের জীবনের অঙ্গ। তাই রাত্রিবেলা দুভাই মিলে (কখনো বা সমবয়স্ক প্রতিবেশী, কখনো বা সহোদর দুই ভাই) গঞ্জিকাতে (গাঁজাতে) টান দিই।

সব দিন হয় না বাজার; হলে, হয় মাত্রাছাড়া,
বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা।

সব দিন বাজার করা হয় না; তবে, যেদিন হয় সেদিন মাত্রছাড়া বা অতিরিক্ত বাজার করা হয়ে যায়। সেদিন আবার বাড়ি ফেরার পথে শখ করে একটা গোলাপের চারাও নিয়ে আসি।

কিন্তু পুঁতব কোথায়? ফুল কি হবেই তাতে?
সে অনেক পরের কথা। টান দিই গঞ্জিকাতে।

গোলাপচারা তো আনা হল কিন্তু পুঁতব কোথায়? যেখানে সেখানে পুঁতে দিলে কি তাতে ফুল হবে? তবে, সেসব অনেক পরের কথা। এখন গঞ্জিকাতে টান দিই।

আমরা তো এতেই খুশি; বলো আর অধিক কে চায়?
হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়।

হোক না অভাব, তবু আমরা তো এই অল্পেই খুশি এর বেশি কেউ চায় না। হেসে-খেলে, শারীরিক পরিশ্রম করে আমাদের দিন চলে যায়।

মাঝে মাঝে চলেও না দিন, বাড়ি ফিরি দুপুররাতে
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়,নুন নেই ঠান্ডা ভাতে।

মাঝে মাঝে আবার দিনযাপন করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অতি সাধারণভাবেও দিন চলে না। অনাড়ম্বর, সাদাকালো জীবনেও যেন একটা অকারণ যতিচিহ্ন নেমে আসে। সেদিন দুপুররাতে (মধ্যরাতে) বাড়ি ফিরি। তারপর যখন খেতে বসে দেখি ঠান্ডা ভাতে নুন পর্যন্ত নেই, তখন মাথায় রাগ ঝরে যায়।

রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি,
বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে সারাপাড়া মাথায় করি।

একে তো নিত্য অভাব-অনটন, তার উপরে নেশা। রাগ সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ হয়ে যায়। রাগ আমার মাথায় চড়ে, আমি রাগের মাথায় চড়ি। রাগের মাথায় কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। বাপ-ব্যাটায় ঝামেলা নাকি ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া, সেসব ভুলে যাই। চিৎকার, চেঁচামেচি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সারা পাড়া জানতে পারে।

করি তো কার তাতে কী? আমরা তো সামান্য লোক
আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।

জানলই বা। আমরা তো নেহাতই সামান্য লোক। আমরা তো বেশি কিছু চাইনা। আমাদের দাবি অতি সামান্য। আমরা চাই, আমাদের শুকনো ভাতে যেন নুনটুকু অন্তত জোটে।

নুন: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর

নুন কবিতা থেকে যতগুলি সম্ভাব্য প্রশ্ন হতে পারে, সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল। এর অতিরিক্ত কোনো প্রশ্নের উত্তর চাইলে আমাকে যোগাযোগ ফর্মের মাধ্যমে জানাবে। আমি চেষ্টা করব যত শীঘ্র সম্ভব উত্তর দেওয়ার। 

প্রশ্ন: “কিন্তু পুঁতবো কোথায়”- কী পোঁতার কথা বলা হয়েছে? এই কথাটিতে বক্তার কোন মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে নিজের ভাষায় লেখো। ১+৪

উত্তর- কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় গোলাপ ফুলের চারা পোঁতার কথা বলা হয়েছে।

অভাবের সংসারে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই সবথেকে বড় পরীক্ষা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন ক্ষুধার্ত মানুষের চোখে “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। কিন্তু মানুষ মাত্রই সৌন্দর্য‍্যের পূজারী। হতদরিদ্র মানুষও সুযোগ পেলে সৌন্দর্য‍্য-বিলাসী হয়ে ওঠে। তেমনটাই দেখা যায় ‘নুন’ কবিতায়। বক্তা একদিন বাজার থেকে একটি গোলাপচারা নিয়ে আসে। কিন্তু গোলাপ চারা আনলেই তো আর গোলাপফুল পাওয়া যাবে না। তখনই তার মনে প্রশ্ন জাগে “কিন্তু পুঁতবো কোথায়?”

এই ছোট্ট একটি প্রশ্নেই পাঠকের কাছে বক্তার মানসিকতা পরিষ্কার হয়ে যায়। বক্তার গোলাপচারা কেনার সামর্থ্য থাকলেও গোলাপ ফুল পরিচর্যা করার মত যথেষ্ট জায়গা নেই। কোনো এক স্বচ্ছল দিনে মাত্রাছাড়া বাজার করার পর তার অতৃপ্ত সৌন্দর্য্য-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য গোলাপ চারা কেনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, গোলাপ যে ‘ফুলের রানী’, তাকে ধনীর উদ্যানেই শোভা দেয়- বস্তির এক চিলতে ঘরে তার জন্য জায়গা কোথায়? আর এভাবেই বক্তার প্রশ্নটি যথাযথভাবে তার মানসিকতাকে ফুটিয়ে তুলেছে।

প্রশ্ন- “আমাদের শুকনো ভাতে লবনের ব্যবস্থা হোক”- কারা কাদের কাছে এই দাবি করেছে? এই দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত? ২+৩ (একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ২০১৪, ২০১৭, ২০১৯, ২০২২)

উত্তর- কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষজন শাসকশ্রেণীর কাছে এই দাবি করেছে।

জন্মসূত্রে আমরা সকলেই সমান কিন্তু মানুষ যত বড় হয় ততই বৈষম্যগুলি প্রকট হতে থাকে। সবকটি বৈষম্যের মধ্যে প্রধানতম হল আর্থিক বৈষম্য কারণ অর্থই হল সভ্যতার চালিকাশক্তি। আর্থিক বৈষম্যই মানুষকে ধনী অথবা নির্ধন হিসাবে চিহ্নিত করে; অতিরিক্ত আহারে কারো শরীরে মেদ জমে, কেউবা অনাহারে দিন কাটায়। আলোচ্য কবিতায় এই সকল নির্ধন, অর্ধভুক্ত কিম্বা অভুক্ত মানুষের চাহিদার কথাই উঠে এসেছে। সমাজ তথা রাষ্ট্রের কান্ডারি শাসকশ্রেণীর কাছে তারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদটুকু দাবি করেছে।

তাদের এই দাবি সম্পূর্ণই সঙ্গত কারণ জীবনধারণের অধিকার মানুষের প্রাথমিক অধিকার আর জীবনধারণের জন্য তিনটি মৌলিক চাহিদা হল অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থান। আধুনিক বিশ্বে প্রতিটি রাষ্ট্রই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র এবং সেখানে প্রতিটি নাগরিকের অন্নসংস্থানের ভার, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। তাই “শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা” করতে বলে বক্তা কোনো অন্যায় আবদার করেনি।

প্রশ্ন- “আমরা তো অল্পে খুশি”–‘অল্পে খুশি’ মানুষদের জীবন-যন্ত্রণার যে ছবি ‘নুন’ কবিতায় ফুটে উঠেছে তার পরিচয় দাও৷ ৫ (একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ২০১৬, ২০২২)

উত্তর- কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতাটি নিছকই একটি কবিতা নয়, বরং বলা যেতে পারে, কবি স্বল্প কথায় সমাজের একটি শ্রেণীর মানুষের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন। সেই শ্রেণীটি হল, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সমাজের দরিদ্র শ্রেণী। আলোচ্য কবিতা অনুসারে তাদের জীবনপ্রণালী নিম্নরূপ-

১) অনাড়ম্বর জীবন- তাদের জীবনযাত্রা একেবারেই বাহুল্যবর্জিত। খেয়ে, পরে বেঁচে থাকা- এটাই তাদের জীবন। খুব সাধারণভাবে, “সাধারণ ভাতকাপড়ে” তাদের দিন কাটে।

২) অল্পেই খুশি- তারা অল্পেই খুশি হতে পারে। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী তবু হাসি মুখে বলতে পারে “কী হবে দুঃখ করে?”

৩) সঞ্চয়হীন- তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকা নির্বাহ করে। যেটুকু উপার্জন করে তা দিয়ে উদরপূর্তি হয় কিন্তু সঞ্চয় করা সম্ভব হয় না। সেইজন্য অসুখ করলে অনাহারে দিন কাটে এবং চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করতে হয়।

৪) বেহিসেবী জীবন– কোনোদিন বেশি টাকা উপার্জন করলে সেই টাকা জমিয়ে রাখা তাদের স্বভাব-বিরুদ্ধ। সেই টাকা দিয়ে ‘মাত্রাছাড়া’ বাজার করে, গোলাপের চারা কিনে বাড়ি ফিরে আসে।

৫) মাদকাসক্তি– অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে নেশা করার প্রবণতা এবং নেশা করার সময় প্রায়শই লঘু-গুরু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

৬) সংযমের অভাব– রাতে খেতে বসে ঠান্ডা ভাতের থালায় নুন না পেলে রেগে এমন হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দেয় যে পাড়ার কেউ জানতে বাকী থাকে না। কে কী ভাবলো এসবের তারা পরোয়া করে না।

৭) বিদ্রোহী– বেঁচে থাকার সামান্যতম রসদেরও অভাব তাদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে। সমাজ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে তারা বলে- “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।”

প্রশ্ন- “আমি তার মাথায় চড়ি” –কে, কার মাথায় চড়ে? পংক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো ৷ ২+৩ (একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ২০১৫)

উত্তর- কবি জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় কথক রাগের মাথায় চড়ে।

‘নুন’ কবিতাটি “দিন আনি দিন খাই” মানুষের যন্ত্রণাময় জীবনযাপনের দিনলিপি। আর্থিকভাবে অসচ্ছল এইসব মানুষেরা “অল্পেই খুশি”। যত দিন যায় তাদের না-পাওয়ার অংকটা বাড়তেই থাকে, তবু তারা সগর্বে বলে- “কী হবে দুঃখ করে?” অসুখ করলে তাদের ধার করা ছাড়া উপায় থাকে না; কখনো অর্থাভাবে নিরন্ন দিন কাটাতে হয়। এইসব দুঃখ-কষ্ট যেন তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুঃখ ভোলার জন্য তারা গঞ্জিকা সেবন করে ঠিকই, কিন্তু সেটাও রাতের অন্ধকারে। সেইজন্য ভদ্রসমাজ তাদের দুঃখটা ঠিক বুঝতে পারেনা।

তারপর একদিন সহ্যের সীমা মাত্রা অতিক্রম করে যায়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর রাত্রিবেলায় খেতে বসে যখন ঠাণ্ডা ভাতে নুনটুকু জোটে না তখন রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এতদিন ধরে না-পাওয়ার যন্ত্রনা ক্ষোভে পরিণত হয় এবং তাদের ক্ষোভের কথা পাড়ার ভদ্র-অভদ্র কারো জানতে বাকি থাকে না। কথকের ভাষায়-

“বাপ-ব্যাটা দু’ভাই মিলে সারা পাড়া মাথায় করি।”

এভাবেই ক্ষুধার জ্বালা তাদের লোকলজ্জার কথা ভুলিয়ে দেয়। রাগ প্রশমিত হলে, সমাজের কাছে তারা অকপটে দাবি জানায়-

“আমাদের শুকনো পাতে লবণের ব্যবস্থা হোক”।

প্রশ্ন: “আমরা তো সামান্য লোক”- কে কোন প্রসঙ্গে এ কথা বলেছে? ‘সামান্য লোক’ শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। [২+৩] (একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ২০১৮, ২০২৩)

উত্তরঃ উত্তর শীঘ্রই দেওয়া হবে।

প্রশ্ন: “মাঝে মাঝে চলেও না দিন,” – কার মাঝে মাঝে দিন চলে না? দিন না চলার কারণ কী? এর মাধ্যমে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার যে ছবি পাওয়া যায় তা লেখাে। [১+২+২] (একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ২০২০)

উত্তরঃ উত্তর শীঘ্রই দেওয়া হবে।

দ্বিতীয় সেমিস্টারের অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তরঃ 

error: Content is protected !!