লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক|| Loukik Sahityer Nana Dik
লোকসংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হলো লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য বলতে বোঝায় সাধারণত লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, ধাঁধা প্রভৃতি। আলোচ্য পোস্টে একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় সেমিস্টারের পাঠ্য ‘লোকিক সাহিত্যের নানা দিক’ অধ্যায় থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরা হলো।
লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
প্রশ্ন: প্রবাদ ও প্রবচন বলতে কী বোঝো? অন্তত চারটি বাংলা প্রবাদের উদাহরণ দাও। (২০১৪, ২০২৩)
উত্তর- লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান হল প্রবাদ ও প্রবচন। একটিমাত্র বাক্য বা বাক্যাংশে যখন একটি জাতির জীবন-অভিজ্ঞতা এবং ভুয়োদর্শনের নির্যাস নিহিত থাকে তখন তাকে প্রবাদ বলা হয়। প্ৰবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি এইরকম-
১) প্রবাদের ব্যবহার সার্বজনীন। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাতেই প্রবাদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
২) একটি বা দুটি বাক্যেই বক্তব্য উপস্থাপিত হয়।
৩) প্রবাদের বাচনভঙ্গি সরস হয় এবং এই সরসতার উপরই প্রবাদের সফলতা নির্ভর করে।
৪) কোনো কোনো রচয়িতার দু’একটি পঙক্তি প্রবাদের মর্যাদা পেলেও বেশিরভাগ প্রবাদের রচয়িতার নাম নেই।
৫) প্রবাদের উপর সাধারণ মানুষের এতোটাই আস্থা থাকে যে বেশিরভাগ প্রবাদকে সত্য বলে মনে করা হয়।
এবারে বলি প্রবচন সম্পর্কে। বর্তমানে যে কথাগুলোকে প্রবাদ বলা হয় আগে সেগুলিকেই বচন বলা হত। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবচন এবং প্রবাদের মধ্যে একটা পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, প্রবাদের মধ্যে একটা গল্পের আভাস থাকে কিন্তু প্রবচন হল ছাঁটা-কাটা কথা।
চারটি বাংলা প্রবাদ হল- ১) মেয়ে বাঁচলেই জামাইয়ের আদর, ২) নেই কাজ তো খই ভাজ, ৩) বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া, ৪) শকুনের নজর ভাগাড়ের দিকেই, ৫) একের বোঝা দশের লাঠি। [শব্দসংখ্যা ১৬০]
প্রশ্ন: ‘ধাঁধার’ বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো ৷ অন্তত দুটি ধাঁধার উদাহরণ দাও। (২০১৫, ২০১৮)
উত্তর- লোকসাহিত্যের একটি অন্যতম অঙ্গ হল ধাঁধা। পৃথিবীর সকল দেশে সকল কালে ধাঁধার প্রচলন ছিল সেকথা আজ প্রমাণিত। সংস্কৃতে প্রহেলিকা, হিন্দিতে পহেলি এবং বাংলায় হেঁয়ালি বলতে যা বোঝায় তাই হলো ধাঁধা।
ধাঁধার বৈশিষ্ট্য– সংক্ষেপে ধাঁধার বৈশিষ্ট্য গুলি হল এইরকম-
১) ধাঁধাগুলির রচয়িতা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কালের স্রোতে এদের রচয়িতার নামগুলি অজ্ঞাতপরিচয় রয়ে গেছে।
২) ধাঁধাগুলি আয়তনে সংক্ষিপ্ত হয়। আগে যেহেতু মৌখিক সাহিত্যের প্রচলন ছিল তাই মনে রাখার সুবিধার জন্য ধাঁধাগুলি দুচার লাইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো।
৩) ধাঁধার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সরসতা। সরস বলেই সেগুলি বহু যুগ অতিক্রম করে এখনো সমান জনপ্রিয় আছে।
৪) প্রতিটি ধাঁধার মধ্যে একটি প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে যার উত্তর হয় পরিচিত কোন বস্তু, বিষয় বা মানুষ।
৫) ধাঁধার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল এর সার্বজনীনতা। ধাঁধা পৃথিবীর সকল দেশে সকল যুগে প্রচলিত ছিল এবং এখনো আছে।
দুটি ধাঁধার উদাহরণঃ
১) সকাল বেলা চার পায়ে হাটে,
দুপুর বেলায় দুই পায়ে হাটে,
বিকাল বেলায় তিন পায়ে হেঁটে
দেশে চলেন বাবাজি। (উত্তর- মানুষ)
২) ঘর আছে দরজা নাই,
মানুষ আছে কথা নাই। (উত্তর- ডিম)
প্রশ্ন: ছড়ার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো ৷ যে-কোনো দুই ধরনের ছড়ার উদাহরণ দাও৷ (২০১৬, ২০১৯)
উত্তর- লোকসংস্কৃতির একটি অন্যতম অঙ্গ হল ছড়া। সংস্কৃত ‘ছটা’ শব্দ থেকে ‘ছড়া’ শব্দটি এসেছে। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে ছড়া হল “কোনো বিষয় লইয়া রচিত গ্রাম্য কবিতা”। ছড়াগুলি সাধারণত মৌখিক আবৃত্তির জন্য মুখে মুখে রচিত হয়। অনেক সময় সুর করেও ছড়া আবৃত্তি করা হয়।
ছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
ক) ছড়া মুলত শিশুতোষ্য রচনা। কোনো বার্তা বা মনোভাব প্রকাশের জন্য ছড়া রচিত হয় না। শিশুদের ভোলানোর জন্য বা ঘুম পাড়ানোর জন্য ছড়ার জন্ম। অবশ্য মেয়েলি ছড়াগুলি একান্তভাবেই মেয়েদের সম্পদ।
খ) শিশুর প্রলাপের মতো অনেক সময় ছড়ার অর্থ অসংলগ্ন হয়। এমনকি ছড়াতে অর্থহীন শব্দও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আসলে শিশুমনে অর্থের বিশেষ কোনো ভুমিকা নেই। তাই ছড়া রচনার সময় অর্থের দিকটি খেয়াল না রাখলেও চলে।
গ) ছড়াতে পরস্পর সম্পর্কহীন কতকগুলি ছবির সমাহার থাকে। শিশুর সদাচঞ্চল মনের মতো ছড়ার কথাগুলি এলোমেলো হয়।
ঘ) ছড়াগুলি মুলত মৌখিক আবৃত্তি করার জন্য। সেজন্য এমন শব্দ ছড়াতে প্রয়োগ করা হয় যা শুনতে ভালো লাগে এবং সহজে মনে থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, শিশুমনের প্রকৃতি সকল যুগে সকল দেশে একইরকমের। তাই সব ভাষাতেই ছড়ার ভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার ছড়াগুলিও বাংলা লোকসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। (শব্দসংখ্যা-১৭০)
প্রশ্ন: লোককথা কাকে বলে? লোককথার যে-কোনো দূটি শাখার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও৷ ১+২+২ (২০১৭) [অথবা, লোককথা কাকে বলে? দুটি লোককথার নাম লেখো এবং যেকোনো একটি লোককথা সম্পর্কে তোমার মত লিপিবদ্ধ করো। ২+১+২ (২০২০)]
উত্তর- লোকসংস্কৃতির প্রধানতম অঙ্গটি হলো লোককথা। যে সকল কথা (বা, কাহিনি) বহুযুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত আছে সেগুলিকে লোককথা বলে।
লোক সমাজে প্রচলিত রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, ব্রতকথা, পুরাণকথা, জনশ্রুতি- এসবই লোককথার অন্তর্গত। নিচে লোককথার দুটি শাখা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
১) রূপকথা– রুপকথা বলতে সাধারণত সেইসব কাহিনিকে বোঝায় যার প্রেক্ষাপটে রয়েছে একটি কল্পিত দেশ, যার নায়ক কোনো একজন ভাগ্যহত রাজপুত্র অথবা সাধারণ দরিদ্র যুবক, যে কাহিনির নায়িকা কোন এক রাজকন্যা এবং অলৌকিক ক্ষমতা, যাদুবিদ্যা প্রভৃতির সমাবেশে এমন এক বিচিত্র ও জটিল ঘটনাক্রমে কাহিনি অগ্রসর হয় যা সাধারণ বুদ্ধিতে অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের রূপকথাতেই নরবলি, নরমাংসভক্ষণ প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এইজন্য পন্ডিতদের অনুমান রূপকথা হল প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের দ্বারা রসসৃষ্টির প্রথম প্রয়াস।
২) ব্রতকথা– বাংলার ব্রতকথাগুলি হল লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারমূলক উপাখ্যান। অনিষ্টকারী দেবতাকে প্রসন্ন করে বরলাভের মাধ্যমে গৃহস্থের কল্যাণসাধন- এই হলো ব্রতকথাগুলির মূল উপজীব্য। দেবতাদের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ভয় এবং ভক্তির কারণে ব্রতকথাগুলি একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল।