লালন শাহ ফকিরের গান|| Lalan Shah Fakirer Gan
বাউল কোনো স্বতন্ত্র ধর্মমত নয়, বাউল হল সাধনা। গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে গেরুয়া বসনধারী যারা বাউল গান করেন, তারা সকলেই সাধক। আর, এই বাউল সাধকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হলেন লালন শাহ্। লালন তার গানের মধ্য দিয়ে সমস্তরকম ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, উদার মানবতার বাণী প্রচার করতেন। (উৎসঃ লালন-গীতিকা, ৩৯১-পদসংখ্যা)
বাউল সাধনা সম্পর্কে দু’চার কথা
বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য দেবালয় অথবা বিভিন্ন পবিত্র স্থানে (বা, তীর্থক্ষেত্রে) যাওয়ার কথা বলা হয়। বাউল সাধকেরা বিশ্বাস করেন, মানব দেহেই ঈশ্বর বিরাজ করেন। বাউল সাধনা আসলে দেহেরই সাধনা এবং এইজন্য বাউল গানকে বলা হয় দেহতত্বের গান। বাউল সাধনতত্ত্ব অনুযায়ী, মানব দেহে ছয়টি চক্র রয়েছে। এই ষট্-চক্র হল— মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্র। এই ছয়টি চক্রের সবথেকে নিচে রয়েছে মূলাধার এবং সব থেকে উপরে, দুই ভ্রূ-র মধ্যিখানে রয়েছে আজ্ঞা চক্র। আজ্ঞা চক্রের ওপরেই বিরাজ করছে বাউলের ত্রিবেণী- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। এখানেই বাউলের আরশিনগর এবং এই আরশিনগরেই থাকে তাদের পরমেশ্বর বা মনের মানুষ বা সোনার মানুষ।
লালন শাহ ফকিরের গান: শব্দার্থ সহ গদ্যরূপ
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।
মানব সাধনা করলে (মানুষ ভজলে) মনের মানুষের সাক্ষাৎ পাবি (সোনার মানুষ হবি।) মানব সাধনা না করলে ওরে ক্ষ্যাপা, তুই সর্বস্ব হারিয়ে ফেলবি। (মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।)
দ্বি-দলের মৃণালে
সোনার মানুষ উজ্জ্বলে
মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে
জানতে পাবি।।
দুই ভ্রূ-র মাঝে যে আজ্ঞা চক্র রয়েছে, যাকে বাউল সাধক দুই দলবিশিষ্ট পদ্ম বলে থাকে, সেখানেই (দ্বিদলে মৃণালে) সোনার মানুষ বা মনের মানুষ পরমেশ্বর স্বমহিমায় অবস্থান করে (সোনার মানুষ উজ্জ্বলে)। বাউল সাধনায় গুরুর সবিশেষ ভূমিকা থাকে এবং সেই গুরুও একজন মানুষ। তার দয়া হলে (মানুষ গুরুর কৃপা হলে) এইসব সাধনমার্গের কথা জানতে পারবি (জানতে পাবি)।
এই মানুষে মানুষ গাথা
দেখনা যেমন আলেক লতা
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
জাতে তরবি।।
এই মানবদেহে (এই মানুষে) আরেক মানুষ অর্থাৎ মনের মানুষ গ্রথিত রয়েছে (মানুষ গাথা), ঠিক যেমন বড় গাছকে অবলম্বন করে থাকে স্বর্ণলতা (দেখ্না যেমন আলেক লতা)। সব জেনেশুনে মস্তক মুন্ডন করো (জেনে শুনে মুড়াও মাথা), ভাবো যে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে তোমার উত্তরণ হবে (জাতে তরবি)।
মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার
লালন বলে, মানুষ-আকার
ভজলে তরবি।।
মানব সাধনা না করলে (মানুষ ছাড়া মন আমার) কোনো কিছুই পাওয়া হবে না বরং শূন্যতা গ্রাস করবে (পড়বি রে তুই শূন্যকার)। সেজন্য লালন শাহ্ বলে (লালন বলে) মানব সাধনা করলেই মানুষ হিসেবে উত্তরণ ঘটবে (মানুষ আকার ভজলে তরবি)।
লালন শাহ ফকিরের গান: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া হল। এগুলি ছাড়াও যদি অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর চাও তাহলে যোগাযোগ ফর্মের মাধ্যমে জানাবে। যদি প্রশ্নটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে যত শীঘ্র সম্ভব উত্তর দেওয়া হবে।
প্রশ্নঃ ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ কবিতায় কীভাবে মানবতার বাণী প্রচারিত হয়েছে।
উত্তরঃ লালন ফকির শুধুমাত্র একজন বাউল সাধক ছিলেন না, একইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন উদার মানবতাবাদী। সমস্তরকম ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি উদার মানবতার বাণী প্রচার করতেন। আলোচ্য ‘লালন শাহ ফকিরের গানে’ও মানবপ্রেমের সুর ধ্বনিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বিশিষ্ট কবি বড়ু চন্ডীদাস বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ আলোচ্য কবিতার শুরুতেই রয়েছে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। সাধক কবি এখানে ইতিবাচক অর্থেই মানব ভজনা বা মানব সাধনার কথা বলেছেন। ঠিক পরের পংক্তিতেই আবার তিনি বলেছেন, মানুষকে ছেড়ে দিলে সর্বস্ব হারাতে হবে। বাউল দর্শন অনুযায়ী কথাগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে কিন্তু আক্ষরিক অর্থে তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে তিনি বলেছেন যে, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। আর এই সত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মানুষকে দেবত্বে উপনীত করেছেন। আচারসর্বস্ব ধর্মাচরণ মানবতার পরিপন্থী। সেজন্য তিনি মস্তক মুন্ডনের সমালোচনা করেছেন।
কবিতার তৃতীয় স্তবকে লালন শাহ্ পুনরায় মানবপ্রীতির কথা বলেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, মানুষের সঙ্গ ছেড়ে দিলে একরাশ শূন্যতা গ্রাস করবে। মানুষের সঙ্গে থেকে, মানুষকে ভালোবেসেই সাধারণ মানুষের উত্তরণ ঘটে। (শব্দ সংখ্যা ১৫৬)
প্রশ্নঃ ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ কবিতায় কীভাবে বাউল সাধনার কথা বা দেহতত্বের কথা উঠে এসেছে, নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তরঃ ভারতীয় উপমহাদেশে যাকে প্রথম ‘মহাত্মা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল সেই লালন ফকিরের লেখা ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতাটি আসলে একটি বাউল গান। বাউল সাধনা মূলত দেহেরই সাধনা। এইজন্য প্রতিটি বাউল গানে দেহতত্বের কথা উঠে আসে। আলোচ্য গানটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
আলোচ্য গানে দেহতত্ত্ব: আলোচ্য বাউল গানটির শুরুতেই রয়েছে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। আবার, এই গানের শেষ লাইনে ওই একই সুরে বলা হয়েছে যে, মানুষের ভজন করলেই উত্তরণ ঘটবে। অর্থাৎ গানটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘মানুষ ভজনের’ কথাই বলা হয়েছে। এই মানুষ ভজনই আসলে মানব সাধন বা দেহসাধন।
বাউল সাধনতত্ত্ব অনুযায়ী, মানব দেহে ছয়টি চক্র রয়েছে। এই ষট্-চক্র হল— মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্র। এই ছয়টি চক্রের সবথেকে নিচে রয়েছে মূলাধার এবং সব থেকে উপরে, দুই ভ্রূ-র মধ্যিখানে রয়েছে আজ্ঞা চক্র। আজ্ঞা চক্রের ওপরেই বিরাজ করছে বাউলের ত্রিবেণী- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। এখানেই বাউলের আরশিনগর এবং এই আরশিনগরেই থাকে তাদের পরমেশ্বর বা মনের মানুষ বা সোনার মানুষ। (শব্দসংখ্যা ১৫০)
প্রশ্নঃ “এই মানুষে মানুষ গাথা”- উদ্ধৃত পংক্তিটিতে ‘মানুষ’ পথটি দুবার ব্যবহার করা হয়েছে কেন? উক্তিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ২+৩
উত্তরঃ কালজয়ী বাউল সাধক তথা দার্শনিক লালন ফকিরের লেখা ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতার উদ্ধৃত অংশে ‘মানুষ’ পদটি দুবার ব্যবহার করা হয়েছে কারণ দু’জন আলাদা মানুষকে বোঝানো হয়েছে। প্রথম মানুষটি হলো একজন রক্তমাংসের মানুষ, আর দ্বিতীয় মানুষটি হলো বাউলদের পরমারাধ্য ঈশ্বর বা মনের মানুষ, সোনার মানুষ।
বাউল কোনো বিশেষ ধর্মমত নয় বরং বলা যেতে পারে, বাউল হল একটি সাধক সম্প্রদায়। প্রচলিত ধর্মমতগুলির থেকে বাউল দর্শন কিছুটা স্বতন্ত্র। তাদের এই স্বাতন্ত্র্য ঈশ্বর উপলব্ধির ব্যাপারে।
বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করার জন্য দেবালয়, উপাসনালয় অথবা অন্য কোনো পবিত্রস্থানে (তীর্থক্ষেত্র) যাওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাউল সাধকেরা নিজের দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের সন্ধান করে বেড়ায়। কারণ, বাউল দর্শন অনুযায়ী, দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। তাদের ঈশ্বরকে তারা কখনো আরশিনগরের প্রতিবেশী, কখনও বা মনের মানুষ বা অচিন পাখি বলে সম্বোধন করে থাকে।
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজমান- এই ভাবনা থেকেই সাধক কবি বলেছেন, ‘এই মানুষে মানুষ গাথা’। পরের পংক্তিতে একটি উপমার সাহায্যে কবি এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘দেখ্না যেমন আলেক লতা’। অর্থাৎ, স্বর্ণলতা যেমন বৃক্ষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে সেরকমই প্রতিটি মানুষে গ্রথিত থাকে তাদের ‘মনের মানুষ’। (শব্দসংখ্যা ১৭০)
প্রশ্নঃ “মানুষ গুরু কৃপা হ’লে/ জানতে পাবি”- কী জানতে পারার কথা বলা হয়েছে? উক্তিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ১+৪
উত্তরঃ মানবতার পূজারি বাউল সাধক লালন ফকিরের লেখা ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতার উদ্ধৃত অংশে বাউল সাধনায় গুরুর একটি বিশেষ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সহৃদয় গুরুর কাছে শিষ্য জানতে পারবে কীভাবে দুই দলবিশিষ্ট পদ্মের উপর ‘সোনার মানুষ’ বিরাজ করে।
বাউল সাধকেরা মনে করে, মানবদেহ হল ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তারা বিশ্বাস করে, “যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভান্ডে”; এমনকি, এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। তাই দেহের সাধনা করলে যেমন ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য প্রকট হয়, তেমনি পরমারাধ্য ঈশ্বরের সান্নিধ্যও লাভ করা যায়। কিন্তু এতসব গূঢ় তত্ত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝাবে কে? এই কাজটি যিনি করে থাকেন তিনিই হলেন গুরু- একজন মানুষ গুরু।
হিন্দু ধর্মেও গুরুকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়। বলা হয় “গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর৷ গুরু রেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।” বাউল সাধকেরাও গুরুর দেখানো পথে সাধনামার্গে অগ্রসর হয়। গুরুর কৃপা না হলে দেহভান্ডের অপার রহস্য ভেদ করা শিষ্যের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ গুরুর কৃপা হলেই ষড়রিপু দমন করে ‘সোনার মানুষের’ সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। (শব্দসংখ্যা ১৫৪)
প্রশ্নঃ “দেখ্না যেমন আলেক লতা”- ‘আলেক লতা’ বলতে কী বোঝায়? কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ১+৪
উত্তরঃ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাউল সাধক লালন ফকিরের লেখা ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় ‘আলেক লতা’ বলতে স্বর্ণলতাকে বোঝানো হয়েছে।
স্বর্ণলতা একটি পরজীবী উদ্ভিদ। সাধারণত কোনো বড় গাছকে অবলম্বন করে স্বর্ণলতা বেড়ে ওঠে। তবে, যে গাছকেই অবলম্বন করুক না কেন, স্বর্ণলতা তার স্বর্ণাভ রঙের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাউল সাধক লালন ফকিরের মতে, এই মানব দেহকে অবলম্বন করে স্বর্ণলতার মতো একজন সোনার মানুষ রয়েছেন, যিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। একজন বাউল সাধকের সাধনাই হল রক্তমাংসের মানুষ থেকে সোনার মানুষে উত্তীর্ণ হওয়া; অথবা, নিজের মধ্যে থাকা সোনার মানুষকে উপলব্ধি করা।
আসলে, বাউল সাধনা হল প্রকৃতপক্ষে দেহেরই সাধনা। তারা বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের সান্নিধ্য পেতে হলে দেবালয়ে অথবা তীর্থক্ষেত্রে যেতে হবে না- দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। সেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হলে একজন গুরুর প্রয়োজন। বাউল সাধনায় গুরুর সবিশেষ ভূমিকা থাকে। গুরুর দেখানো পথেই সাধকের সিদ্ধিলাভ সম্ভব। এইভাবে, সাধনমার্গের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হলে একজন সাধক উপলব্ধি করতে পারবে যে তাকে আশ্রয় করেই রয়েছেন ‘আলেক লতা’, সাধকের পরমারাধ্য ‘সোনার মানুষ’। ( শব্দসংখ্যা ১৫২)