ভূমিকা
সূচিপত্র
ভাষাকে সঠিকভাবে জানার জন্য ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ব্যাকরণ হল, ব্যাপক অর্থে, ভাষা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা। বর্তমানে যদিও ভাষা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ভাষাবিজ্ঞান (Linguistic) নামক একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র রয়েছে। তবে এখন আমরা প্রচলিত ব্যাকরণ নিয়েই আলোচনা করব।
বাংলা ব্যাকরণ বনাম ইংরেজি গ্রামার
আমরা অনেকেই মনে করি ইংরেজি Grammar শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘ব্যাকরণ’। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। মহামহােপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, “সংস্কৃত বা বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরাজী Grammar এক জিনিস নয়। Grammar is the art of speaking and writing a langnage correctly.’..’ব্যক্তিয়ন্তে ব্যুৎপাদান্তে শব্দা অনেন ব্যাকরণং’; অর্থাৎ, শব্দটি শুদ্ধ করা পর্যন্তই [সংস্কৃত] ব্যাকরণের সীমা। সুতরাং ইংরেজি গ্রামার ও সংস্কৃত [বা বাংলা] ব্যাকরণ এক নহে।”
‘ব্যাকরণ’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় বি (বিশেষ)- আ (সম্যক)- কৃ (করণ) + অন (ন)।এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল, বিশেষরূপে এবং সম্যকরূপে বিশ্লেষণ করা। ভাষাকে বিশেষভাবে এবং সম্যকরূপে বিশ্লেষণ করার বিদ্যাই হল ব্যাকরণ।
বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস
পৃথিবীর প্রতিটি আধুনিক ভাষার যেমন ব্যাকরণ রয়েছে, তেমনি বাংলা ভাষারও ব্যাকরণ রয়েছে। বাংলা ব্যাকরণ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করার আগে দেখে নেওয়া যাক বাংলা ব্যাকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বাংলা ব্যাকরণের বয়স আড়াইশো বছরের কিছু কম। আর প্রথম বাংলা ব্যাকরণ যিনি লিখেছিলেন তিনি কোনো বাঙালি ছিলেন না, এমনকি কোনো ভারতীয়ও ছিলেন না। পর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল-দ্য-অসুম্পসাম ছিলেন প্রথম বাংলা ব্যাকরণের রচয়িতা। তাঁর গ্রন্থের নাম “Vocabulario em Idioma Bengalla Portuguez”। এর কিছুকাল পরে ইংরেজ পন্ডিত হ্যালহেড ইংরেজি ভাষায় ‘বাংলা ব্যাকরণ’ রচনা করেছিলেন। ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়ও ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর বইয়ের নাম ছিল The Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮) যেটি পরে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩) নামে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে আরো অনেক বাঙালি পন্ডিত বাংলা ব্যাকরণ রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। তবে এঁদের কেউই সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারেন নি। তাই এখনো পর্যন্ত যথার্থ বাংলা ব্যাকরণের অভাব রয়েই গেছে।
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
প্রথমত, ব্যাকরণ হল ভাষার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ। তাই কোনো ভাষাকে যথার্থভাবে জানতে হলে ব্যাকরণ পড়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, ভাষার ক্ষুদ্রতম উপাদান হল ধ্বনি। ব্যাকরণ ধ্বনি এবং ধ্বনি পরিবর্তন বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করে।
তৃতীয়ত, ভাষার আসল সম্পদ হল শব্দভাণ্ডার। ব্যাকরণ পড়লে ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের উৎস, বিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে জানা যায়।
চতুর্থত, ভাষার বৃহত্তম উপাদান হল বাক্য। ব্যাকরণে বাক্যের গঠন, বাক্যের প্রকারভেদ, বাক্য পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে।
পঞ্চমত, শব্দের অর্থ এবং শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ, শব্দার্থ পরিবর্তনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে জানার জন্য ব্যাকরণ পাঠ অপরিহার্য।
বাংলা ব্যাকরণের সমস্যা
বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে জানার জন্য এবং বিশুদ্ধভাবে প্রয়োগের জন্য বাংলা ব্যাকরণ পাঠ করা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ-শিক্ষার বেশ কিছু বাস্তব সমস্যা রয়েছে। সেগুলি হল-
প্রথমত, বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষার পথে প্রধান বাধা হল যথার্থ বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের অভাব। আগে যেসকল পন্ডিত বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন তাঁরা সকলেই সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন। এইজন্য বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করতে গিয়ে তাঁরা সংস্কৃত ব্যাকরণ দ্বারা প্রভাবিত হতেন। স্বয়ং রবিঠাকুর বলেছিলেন,
“আমরা যেমন বিদ্যালয়ে ভারতবর্ষের নাম দিয়া মহম্মদ ঘােরী, বাবর, হুমায়ুনের ইতিহাস পড়ি, তাহাতে অতি অল্প পরিমাণ ভারতবর্ষ মিশ্রিত থাকে, তেমনি আমরা বাংলা ব্যাকরণ নাম দিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়িয়া থাকি, তাহাতে অতি অল্প পরিমাণ বাংলার গন্ধ থাকে মাত্র।”
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে স্কুল-পাঠ্য ব্যাকরণ বইগুলির অবস্থা আরও হতাশাজনক। বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ইত্যাদি বিষয়ে কোনো সার্বজনীন মতামত না থাকায় একেক বইয়ে একেক রকম লেখা থাকে। এর ফলে শিক্ষার্থী বিভ্রান্ত হয় এবং বাংলা ব্যাকরণের প্রতি তার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন, বাংলা ব্যাকরণে সমাস কয় প্রকার? কোনো বইয়ে আছে ছয় প্রকার- দ্বন্দ, তৎপুরুষ, কর্ম, দ্বিগু, বহুব্রীহি এবং নিত্য; কোনো বইয়ে এই ভাগগুলির সঙ্গে অব্যয়ীভাব সমাসকে যোগ করে সাত প্রকার সমাসের কথা বলা হয়েছে। কোনো কোনো বইয়ে আবার বাক্যাশ্রয়ী সমাস, অলুক সমাসকে ধরে মোট নয় প্রকার সমাসের কথা বলা হয়েছে। আর এইভাবে স্কুল-পাঠ্য ব্যাকরণ বইগুলি ছাত্রছাত্রীদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে যা কখনোই কাম্য নয়।
তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় প্রচলিত তৎসম শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করতে গেলে সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারস্থ হতেই হবে। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের কঠিন নিয়ম আয়ত্ত করতে গিয়ে নবীন শিক্ষার্থী ব্যাকরণের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যেমন, ‘জগৎ’ শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয় নির্ণয় করলে পাওয়া যায় √গম্ + ক্বিপ। কিন্তু গম্ এবং ক্বিপ শব্দদুটির মিলনে কীভাবে জগৎ শব্দটি এলো, তা জানতে হলে শিক্ষার্থীকে সংস্কৃত প্রত্যয়ের উক্ত নিয়মটি জানতে হবে।
চতুর্থত, বর্তমানে বাংলা ব্যাকরণ চর্চা বিদ্যালয়ের গন্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাকরণ পঠনপাঠন হয় কিন্তু উচ্চতর শ্রেণিতে ভাষাবিজ্ঞানের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এইজন্য বাংলা বিষয়ে স্নাতক- স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলেও ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ব্যাকরণের কিছুই শিখছে না। এরপর কেউ যদি শিক্ষকতার পেশায় আসতে চায় তাকে তখন নতুন করে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে বাংলা ব্যাকরণ শিখতে হয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও বাংলা ব্যাকরণ চর্চার ব্যবস্থা থাকলে এই ধরণের সমস্যা হতো না।
পঞ্চমত, আধুনিককালে, ব্যাকরণের স্থান দখল করেছে ‘ভাষাবিজ্ঞান’। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই বাংলা ভাষাতেও ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়ে গেছে। ভাষাবিজ্ঞান হল প্রকৃত অর্থেই ভাষার বিজ্ঞান। এর পরিধি প্রচলিত ব্যাকরণের থেকে বহুগুণ বেশি এবং এর আলোচনা পদ্ধতি অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত। সেইজন্য বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য বিষয়ে যারা উচ্চতর শিক্ষা লাভ করছে তারা ব্যাকরণের থেকে ভাষাবিজ্ঞানের দ্বারা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।