উপসর্গ
সূচিপত্র
যে ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ অন্য শব্দের আগে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে উপসর্গ বলা হয়। উপসর্গ কথাটির সাধারণ অর্থ হল লক্ষণ। কিন্তু, বাংলা ব্যাকরণে উপসর্গ হল নতুন শব্দ গঠনের অন্যতম উপায়। এরা স্বাধীন পদ হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে না, কিন্তু কোনো পদের আগে বসে তার অর্থ পরিবর্তন করতে পারে। যেমন, নিচের উদাহরণে √কৃ ধাতুনিষ্পন্ন ‘কার’ (√কৃ+ঘঞ্) শব্দটির আগে চারটি উপসর্গ যোগ করে নতুন চারটি শব্দ পাওয়া গেল।
আ + কার (√কৃ+ঘঞ্) = আকার
বি + কার (√কৃ+ঘঞ্) = বিকার
উপ + কার (√কৃ+ঘঞ্) = উপকার
অপ + কার (√কৃ+ঘঞ্) = অপকার
উপসর্গ বনাম অনুসর্গ
প্রথমতঃ উপসর্গের স্থান শব্দের আগে, কিন্তু অনুসর্গের স্থান শব্দের পরে।
দ্বিতীয়তঃ শব্দের সঙ্গে উপসর্গ যোগ করে নতুন শব্দ পাওয়া যায়, কিন্তু অনুসর্গ নতুন শব্দ গঠন করতে পারে না।
তৃতীয়তঃ উপসর্গ শব্দের সঙ্গে মিশে যায়, কিন্তু অনুসর্গ শব্দের থেকে একটু তফাতে বসে।
চতুর্থতঃ উপসর্গগুলির নিজস্ব অর্থ থাকে না; তবে, কোনো শব্দের সঙ্গে যুক্ত সেই শব্দের অর্থ পরিবর্তন করতে পারে। অপরপক্ষে, অনুসর্গের নিজস্ব অর্থ থাকে।
পঞ্চমতঃ উপসর্গগুলির ভূমিকা নতুন শব্দ গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বাক্যগঠনে উপসর্গের কোন ভূমিকা থাকে না। অপরপক্ষে, অনুসর্গ বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।
সংস্কৃত উপসর্গ
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সংস্কৃত উপসর্গের সংখ্যা কুড়ি। এই উপসর্গগুলি সবসময় একই অর্থে প্রযুক্ত হয় না, বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়। নীচে সংস্কৃত উপসর্গগুলির প্রয়োগ দেখানো হল।
[প্ৰ]– (আধিক্য, উৎকর্ষ, বৈপরীত্য ইত্যাদি অর্থে) প্রগতি, প্রখ্যাত, প্রতাপ, প্ৰহার, প্রগাঢ়, প্রবর্তন, প্রস্থান, প্রবেশ, প্ৰকার, প্রদেশ, প্রস্তাব, প্রবাহ, প্রখর, প্রলাপ, প্রকট, প্রখর ইত্যাদি।
[পরা]- (আধিক্য, সম্যক, বৈপরীত্য ইত্যাদি অর্থে) পরাভব, পরাগত, পরাজয়, পরাক্রম, পরামর্শ, পরায়ণ ইত্যাদি।
[অপ]-(বৈপরীত্য, মন্দ ইত্যাদি অর্থে) অপকার, অপব্যবহার, অপহরণ, অপসারণ, অপচয়, অপবাদ, অপব্যয়, অপরাধ, অপমৃত্যু ইত্যাদি।
[সম্]- (অভিমুখ, সম্যক, সংযোগ ইত্যাদি অর্থে) সম্মুখ, সংবাদ, সঞ্জয়, সন্ধান, সম্পূর্ণ, সমীক্ষা, সম্ভার, সম্পাদন, সংকলন ইত্যাদি।
[নি]- (অতিশয়, সম্যক ইত্যাদি অর্থে) নিসর্গ, নিক্ষেপ, নিদাঘ, নিবিষ্ট, নিকৃষ্ট, নিবাস, নিপাত, নিদর্শন, নিবারণ, নিষেধ, নিগ্রহ ইত্যাদি।
[অব]- (নিম্ন, হীনতা ইত্যাদি অর্থে) অবগাহন, অবমাননা, অবনমন, অবতার, অবনত, অবজ্ঞা, অবদান, অবচেতনা, অবসর, অবতরণ, অবকাশ, অবসাদ, অবরােহণ ইত্যাদি।
[অনু]- (পশ্চাৎ, সাদৃশ্য, ইত্যাদি অর্থে) অনুচর, অনুকরণ, অনুতাপ, অনুক্ষণ, অনুগত, অনুজ্ঞা, অনুদান, অনুপ্রবেশ, অনুজ, অনুশোচনা, অনুগ্ৰহ, অনুরূপ, অনুকূল ইত্যাদি।
[নির্/নিঃ]- (সম্যক, অভাব ইত্যাদি অর্থে) নির্বাক, নির্ণয়, নিরক্ষর, নির্গত, নীরব, নির্লোভ, নির্দিষ্ট, নির্দেশ, নির্ভীক, নির্ধন, নিরাশ, নিরানন্দ, নিরীক্ষণ, নির্ধারণ ইত্যাদি।
[দুর্/ দুঃ]- (অভাব, মন্দ, কাঠিন্য ইত্যাদি অর্থে) দুর্জয়, দুর্বল, দুর্ভিক্ষ, দুর্নাম, দুর্ঘটনা, দুর্দম, দুশ্চরিত্র, দুরাশয়, দুর্বার, দুর্গম, দুরাশা ইত্যাদি।
[বি]- (বৈপরীত্য, বিশেষ, অভাব ইত্যাদি অর্থে) বিক্রম, বিজ্ঞান, বিস্তার, বিনিয়োগ, বিখ্যাত, ব্যবধান, বিনিদ্র, বিবর্ণ, বিবাদ, বিলাপ, বিকার, বিকাশ, বিক্রয়, বিক্ষত, বিজয়, বিয়োগ, বিক্রয়, বিধর্মী ইত্যাদি।
[অধি]- (ঊর্ধ্বে, প্রাধান্য ইত্যাদি অর্থে) অধিকার, অধিগত, অধিপতি, অধিকৃত, অধিনায়ক, অধিগ্রহণ, অধিবেশন, অধিষ্ঠান ইত্যাদি।
[সু]- (উৎকর্ষ, অনায়াস, অতিশয় ইত্যাদি অর্থে) সুচারু, সুদৃশ্য, সুগম, সুকণ্ঠ, সুদর্শন, সুসময়, সুবােধ, সুশীল, সুরম্য, সুসংবাদ, সুলভ, সুতীব্র, সুকর ইত্যাদি।
[উদ্]- (উৎকর্ষ, উচ্চ, মন্দ ইত্যাদি অর্থে) উৎকর্ষ, উৎকৃষ্ট, উচ্ছ্বাস, উদ্ভব, উদ্যােগ, উন্নতি, উদগিরণ, উৎক্ষেপণ, উৎপাদন, উদ্ভিদ, উচ্ছেদ, উজ্জ্বল, উৎকট, উৎকোচ ইত্যাদি।
[পরি]- (সম্যক, অতিশয় ইত্যাদি অর্থে) পরিবার, পরিজন, পরীক্ষা, পরিবহণ, পরিবর্তন, পরিপূর্ণ, পরিপক্ক, পরিপুষ্ট, পরিবেশ, পরিভ্রমণ, পরিচালনা, পরিচয়, পরিণয় ইত্যাদি।
[প্রতি]- ( বিপরীত ইত্যাদি অর্থে) প্রতিষ্ঠা, প্রতিকূল, প্রতিবাদ, প্রতিকার, প্রতিঘাত, প্রতিহিংসা, প্রতিদান, প্রত্যাখ্যান, প্রত্যাবর্তন, প্রতীক্ষা ইত্যাদি।
[অভি]- (সম্যক, অভিমুখে ইত্যাদি অর্থে) অভ্যাস, অভিনেতা, অভ্যাগত, অভিবাদন, অভিভূত, অভিনন্দন, অভিমান, অভিমুখ, অভিযান, অভিযোগ, অভিসার ইত্যাদি।
[অতি]- (অতিশয় ইত্যাদি অর্থে) অতিবৃষ্টি, অতিশয়, অতিক্রান্ত, অতিরঞ্জন, অতিমানব, অতিপ্রাকৃত, অতিভােজন, অত্যুক্তি, অত্যাচার, ইত্যাদি।
[অপি]- (পূর্বে অবস্থান অর্থে) অপিনিহিতি, অপিচ, অপিধান ইত্যাদি। (বাংলায় এই উপসর্গের প্রয়ােগ কম।)
[উপ]- (সম্যক, ক্ষুদ্র, নিকট ইত্যাদি অর্থে) উপকার, উপহার, উপভোগ, উপদেশ, উপমহাদেশ, উপসাগর, উপদ্বীপ, উপগ্রহ, উপসচিব, উপদ্রব, উপবিষ্ট ইত্যাদি।
[আ]- (বৈপরীত্য, সম্যক, পর্যন্ত ইত্যাদি অর্থে) আগত, আগমন, আসক্ত, আচার, আহার, আকীর্ণ, আকৃষ্ট, আকন্ঠ, আমৃত্যু ইত্যাদি।
বাংলা উপসর্গ
[অ] (নয়/না/ মন্দ অর্থে)- অজানা, অফুরান, অদেখা, অচেনা, অনড়, অবুঝ ইত্যাদি।
[অনা] (নয়/না/ মন্দ অর্থে)- অনাসৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অনামুখাে ইত্যাদি।
[আ] (নয়/না/ মন্দ অর্থে)- আগাছা, আকাল, আঘাটা, আধােয়া, আকাড়া, আছোলা ইত্যাদি।
[না] (নয়/ না অর্থে)- নাচোড়, নাবালক, নামঞ্জুর, নারাজ ইত্যাদি।
[বি] (নয়/না/মন্দ অর্থে)- বিকল, বিদেশ, বিজোড়, বিপথ, বিজাত ইত্যাদি।
[কু] (মন্দ অর্থে) কুপথ, কুকথা, কুনজর, কুকাজ ইত্যাদি।
[নি] (নয়/না অর্থে)- নিখরচা, নিখুঁত, নিলাজ, নিটোল ইত্যাদি।
[ভর] (পূর্ণ অর্থে)- ভরপেট, ভরসন্ধ্যা, ভরদুপুর ইত্যাদি।
[ভরা] (পূর্ণ অর্থে)- ভরাডুবি, ভরানদী, ভরাযৌবন ইত্যাদি।
[হা] (অভাব অর্থে)- হাঘরে, হাহুতাশ, হাভাতে, হাপিত্যেশ ইত্যাদি।
[পাতি] (ক্ষুদ্র অর্থে)- পাতিকুয়া, পাতিহাঁস, পাতিকাক, পাতিলেবু ইত্যাদি।
[রাম] (বৃহৎ অর্থে)- রামধােলাই, রামদা, রামছাগল ইত্যাদি।
[স] (সহিত অর্থে)- সটান, সজোর, সঠিক ইত্যাদি।
[সু] (উত্তম অর্থে)- সুজন, সুনজর, সুডৌল, সুখবর, সুছাঁদ, সুরাহা, সুঠাম ইত্যাদি।
বিদেশি উপসর্গ
বাংলায় বেশ কয়েকটি বিদেশি উপসর্গের ব্যবহার রয়েছে। এগুলি মূলত বিদেশি শব্দ (বিশেষত ফারসি ও ইংরেজি শব্দ) কিন্তু বাংলা ভাষায় এরা উপসর্গরূপে ব্যবহৃত হয় এবং তৎসম, তদ্ভব, দেশি বা বিদেশি শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ গঠন করে। যেমন-
গর (না অর্থে)- গরমিল, গরহাজির, গররাজি ইত্যাদি।
ফি (প্রতি অর্থে)- ফি-বছর, ফি-হপ্তা, ফি-সন ইত্যাদি।
বে (না অর্থে)- বেআইনি, বেহিসেবি, বেহায়া, বেসামাল, বেপাত্তা, বেপরােয়া ইত্যাদি।
হর (প্রত্যেক অর্থে)- হররােজ, হরদিন, হরসাল ইত্যাদি।
বদ (নিন্দা অর্থে)- বদমেজাজি, বদরাগি, বদনাম, বদহজম ইত্যাদি।
দর (অল্প অর্থে)- দরপাকা, দরদালান, দরকাঁচা, দরসেদ্ধ ইত্যাদি।
নিম (প্রায় বা অর্ধ অর্থে)- নিমরাজি, নিমখুন ইত্যাদি।
হেড-(প্রধান অর্থে) হেডপণ্ডিত, হেড়অফিস, হেডক্লার্ক, হেডমিস্ত্রি ইত্যাদি।
সাব (অধীন অর্থে)- সাব-জজ, সাব-অফিস, সব-ডেপুটি ইত্যাদি।
ফুল (পুরো অর্থে)- ফুল-প্যান্ট, ফুল-মোজা, ফুল-হাতা ইত্যাদি।
হাফ (অর্থ অর্থে)- হাফ-হাতা, হাফপ্যান্ট, হাফ-টাইম, হাফ-ছুটি ইত্যাদি।
মিনি (ক্ষুদ্র অর্থে)- মিনিবাস, মিনিট্রাক, মিনিখাতা ইত্যাদি।