বাংলা প্রবাদ প্রবচন

প্রবাদ ও প্রবচন

প্রবাদ ও প্রবচন হল লোকসাহিত্যের অঙ্গ। কিছু কথা আছে যাদের আয়তন কম কিন্তু ওজন একটু বেশি। সেসব কথায় কিছু গল্পের আভাস থাকে। আর, এই কথাগুলি শুনলে মনে হয় সেগুলি যেন দীর্ঘ জীবন-অভিজ্ঞতার ফসল। এইসব কথাগুলিকেই প্রবাদ বলা হয়। আর, প্রবচনগুলি হল আকারে সংক্ষিপ্ত। নিচে বহু প্রচলিত পঞ্চাশটি প্রবাদ-প্রবচনের উদাহরণ দেওয়া হল।

বাংলা প্রবাদ-প্রবচন

১. অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট [বেশি লোকে কাজ পন্ড হয়]:- একটি রাস্তার উদ্বোধন করতে তিনজন নেতাবাবু এসে উপস্থিত। এখন দেখছি অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হবার উপক্রম।

২. অন্ধকারে ঢিল ছোড়া [আন্দাজে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা]:- আমরা অনেক সময় অন্ধকারে দিল ছুড়ে দিয়ে পান্ডিত্য ফলাবার চেষ্টা করি।

৩. অন্ধের কি দিন কিবা রাত্রি [অন্ধের কাছে দিনরাত্রির পার্থক্য নেই]:- লাল্টুকাকুকে আজকের পত্রিকাটা দিলাম কিন্তু একবারও উল্টে পাল্টে দেখলো না। তারপর বুঝলাম লাল্টুকাকু তো স্বাক্ষর নয়। হায় রে, অন্ধের কি দিন কিবা রাত্রি।

৪. অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী [অল্প বিদ্যা প্রায়শই বিপদ ডেকে আনে]:- ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে সে মায়ের চিকিৎসা করতে গিয়েছিল, এখন তার মা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। একেই বলে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।

৫. আকাশ কুসম [অসম্ভব কল্পনা]:- হঠাৎ করেই একদিন মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর হয়ে যাবে এমন আকাশ কুসুম কল্পনা কোরো না।

৬. উলু বনে মুক্তো ছড়ানাে [অপাত্রে সদুপদেশ বর্ষণ]:- সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে যেন পানীয় জল অপচয় করা না হয় কিন্তু মানুষ জল অপচয় করেই যাচ্ছে। এ যেন সেই উলু বনে মুক্তো ছড়ানো হচ্ছে।

৭. কানপাতলা [যে পরের কথা সহজেই বিশ্বাস করে]:- তোমার মতো কানপাতলা লোক দেখিনি। কেউ একজন বললে সোনার দাম কমে গেছে অমনি তুমি ছুটলে সোনার দোকানে।

৮. কূপমণ্ডূক [বিশ্ববিমুখ]:- এখনো যারা ছাপার অক্ষরে লেখাকে নির্ভুল মনে করে তারা কূপমণ্ডূক ছাড়া আর কিছু নয়।

৯. কেঁচো খুঁড়তে কেউটে [সামান্য ব্যাপার থেকে বিশাল কিছুর হদিস মেলা]:- এক চোরকে ধরতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারলো সে আসলে একজন সন্ত্রাসবাদী। এ তো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ল।

১০. কৈ মাছের প্রাণ [অত্যন্ত কষ্ট-সহিষ্ণু]:- শ্রমজীবী মানুষদের দেখলে মনে হয় তাদের যেন কৈ মাছের প্রাণ। রোদ-জল উপেক্ষা করে তারা সভ্যতার রথের চাকা সচল রাখে।

০১১ খয়ের খাঁ [মােসাহেব ]:- অনিকেতবাবু যেই নেতা থেকে মন্ত্রী হলেন অমনি তার ডাইনে-বাঁয়ে অনেক খয়ের খা এসে হাজির হল।

১২. গল্ডলিকা প্রবাহ [বিচার বিবাচনা না করে অন্ধ অনুসরণ]:- নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে কাজ করো, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিও না। নাহলে সারাজীবন আফসোস করতে হবে।

১৩. গভীর জলের মাছ [বুদ্ধিমান ও চাপা স্বভাবের মানষ]:- মতিবাবুর সহজ সরল কথা শুনে গলে যেও না, উনি আসলে গভীর জলের মাছ।

১৪. গেঁয়াে যােগী ভিখ পায় না [চেনা গুণীর কদর নেই]:- স্থানীয় ভালো শিল্পী থাকলেও বড় অনুষ্ঠানে সবাই বাইরের শিল্পীদের ডেকে আনে। আসলে গেঁয়ো যোগী তো ভিখ পায় না।

১৫. গৌরচন্দ্রিকা [ভণিতা]:- বেশি গৌরচন্দ্রিকা না করে বল কী চাও।

১৬. ঘুটে পােড়ে, গােবর হাসে [যখন সকলের সামনে সংকট তখন বিশেষ কাউকে বিপদে পড়তে দেখে খুশি হওয়া]:- মধুবাবুর বাড়িতে চুরি হয়েছে শুনে পাড়ার অনেকেই হাসিঠাট্টা করছে। কিন্তু, কেউ এটা ভাবছে না যে কাল অন্যের বাড়িতেও চুরি হতে পারে। আসলে, এটাই মানুষের স্বভাব- ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে।

১৭. ছাই ফেলতে ভাঙা কুলাে[সম্মানের নয় অথচ]:- রতনবাবুকে সবাই হাতুড়ে ডাক্তার বলে অবজ্ঞা করে। কিন্তু রাতে কেউ অসুস্থ হলে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো সেই রতনবাবুরই ডাক আসে।

১৮. ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি [দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির জন্যে ব্যাকুলতা]:- হোস্টেলের দায়িত্ব নেওয়ার দুদিন পরেই দত্তবাবুর অবস্থা সেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। তিনি যে কোনো প্রকারে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চান।

১৯. জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ [উভয় সংকট]:- আগে স্কুলে পড়া না পারলে মার খেতে হতো এবং মারের ভয়ে স্কুল না গেলে মায়ের কাছে দ্বিগুণ মার খেতাম। যেন জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ এবং মধ্যিখানে আমরা।

২০. ঠক বাছতে গাঁ উজাড় [সৎ ব্যক্তির সংখ্যা নগণ্য]:- হুকিং বন্ধ করার জন্য ইলেকট্রিক অফিস থেকে লোক এসে দেখল গ্রামের সকলেই হুকিং করেছে। ইলেকট্রিক অফিসের লোকজন ভেবে পায় না কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে, কারণ, ঠক বাছতে গাঁ উজাড়।

২১. ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে [উন্নত অবস্থায়ও স্বভাবের পরিবরর্তন না হওয়া]:- বংশী লটারি টাকায় লাখপতি হয়েও লোকের ঘরে ঘরে চাল আদায় করে। কথায় আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে।

২২. দশচক্রে ভগবান ভূত [দশজনের চক্রান্তে অসম্ভবও সম্ভব হয়]:- শিবদাসবাবু সজ্জন ব্যক্তি, কিন্তু তার অফিসের কয়েকজন মিলে তাকে ঘুষখোর অপবাদ দিল। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়, তাই শিবদাসবাবুও ঘুষখোর তকমা পেয়ে গেলেন।

২৩. দশের লাঠি একের বােঝা [বহুজনের দ্বারা অনায়াস-সাধ্য কাজ একজনের পক্ষে দুঃসাধ্য]:- রুমা একাই ক্লাসরুমের আবর্জনা সাফ করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। সবাই মিলে করলেই ভালো হতো কারণ, দশের লাঠি একের বোঝা।

২৪. ধর্মের কল বাতাসে নড়ে [সত্যের জয় হয়]:- জনার্দনবাবু টাকার জোরে কেস জিতে গেলেন কিন্তু মামলার ফল ভোগ করতে পেলেন না। তিনি মারা গেলেন এবং সব সম্পত্তি পুনরায় তার ভাইপো পেল। এইজন্য বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।

২৫. ধান ভানতে শিবের গীত [ অপ্রাসঙ্গিক কথা ]:- রোহিতকে বলা হল একটা ভালো সেলফি তুলে দিতে। তখন ও ফটোগ্রাফির ইতিহাস বলতে শুরু করল। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কোনো কারণ আছে?

২৬. ধরি মাছ না ছুঁই পানি [সুবিধাবাদী]:- সৌরভ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সব সুযোগ সুবিধা নেয় কিন্তু কোনো মিটিংয়ে যায় না। ওর মনোভাব হল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’।

২৭. ধনুকভাঙা পণ [ভীষণ প্রতিজ্ঞা]:- জয়া এই সেমিস্টারে ফার্স্ট ক্লাস পাবেই। একপ্রকার ধনুকভাঙা পণ করে পড়ায় মন দিয়েছে সে।

২৮. নয়-ছয় [নষ্ট করা]:- সায়নী লক্ষীপুজোর দিন আলপনা দিতে গিয়ে মায়ের আঁকা নকশাগুলো নয়-ছয় করে ফেলল।

২৯. নুন আনতে পান্তা ফুরায় [অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ টানাটানি অবস্থা]:- চাকরি হারিয়ে দিবাকরবাবুর অবস্থা এমন যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

৩০. ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যান [অল্পেই কাতর হওয়া]:- কোয়েল বিয়ের পর এমন হয়েছে যেন ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাবে। সামান্য পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে সেদিন কেঁদে ভাসিয়ে দিল।

৩১. বরের ঘরের মাসী, কনের ঘরের পিসী [যার কাছে যেমন]:- রামপ্রসাদবাবু কোন দলের লোক সেটা কেউ জানে না। আসলে উনি বরের ঘরের মাসী আর কনের ঘরের পিসী সেজেই থাকেন।

৩২. বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় [বড়াের চেয়ে ছােটোর অধিক আস্ফালন ]:- বড়বাবু মাটির মানুষ কিন্তু তার চেলাটি ধুরন্ধর। কথায় আছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।

৩৩. বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা [আসল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ] :- সব তো ঠিক হলো কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?

৩৪. বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া [ভাগ্যক্রমে প্রত্যাশিত সুযোগ লাভ]:- কেউ ভাবেনি যে দুলালবাবু একদিন বড়লোক হবেন। বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো ভাগ্যিস লটারির টাকাটা জিতলেন, নাহলে এতদিনে ভিক্ষা করতে হতো।

৩৫. বিনা মেঘে বজ্রাঘাত [অপ্রত্যাশিত অপ্রীতিকর ঘটনা বা দুঃসংবাদ]:- ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে ভদ্রমহিলা খবর পেলেন যে তার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত।

৩৬. ভস্মে ঘি ঢালা [অপাত্রে দান করা]:- মাধ্যমিকে দু’বার ফেল করা ছেলেকে ডাক্তার বানাবার জন্য বাবা মা সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে বসে আছে। ওরা যেদিন বুঝবে যে, এতোদিন ধরে তারা ভস্মে ঘি ঢেলে এসেছে, তখন আর কিছু করার থাকবে না।

৩৭. ভাঙে তবু মচকায় না [পরাজিত হয়েও পরাজয় স্বীকার করে না]:- অঙ্কিতা খুবই তর্কবাজ। ও সবার সঙ্গে তর্ক করে এবং হেরেও যায়, কিন্তু কখনোই হার স্বীকার করে না। ওর স্বভাবই হল ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না’।

৩৮. মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন [ অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে মরণপণ]:- যতদিন না একটা চাকরি পাচ্ছি ততদিন কোথাও বেড়াতে যাবো না। এখন একটাই কথা- মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।

৩৯. মশা মারতে কামান দাগা [সামান্য কাজের জন্যে বিশাল ব্যবস্থা]:- নার্সারি স্কুলের বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য তিনটে হোম টিউশন রাখা হয়েছে। মশা মারতে কামান দাগার ব্যবস্থা করেছে শিশুটির মা-বাবা।

৪০. মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম [ভুল সবারই হয়]:- অংকের মাস্টারমশাই বোর্ডে অংক করানোর সময় যদি প্লাস-মাইনাসে হেরফের ঘটে তখন আমাদের মনে হয়, মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম।

৪১. মেঘ না চাইতে জল [অপ্রত্যাশিতভাবে অধিক প্রাপ্তি]:- সকাল থেকেই ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল। হঠাৎ দুপুরে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, মেঘ না চাইতে জল পেয়েছি।

৪২. যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ [শেষ পর্যন্ত আশা পােষণ করা]:- ম্যাচ হারবো জেনেও শেষ বলটি খেলা না হওয়া পর্যন্ত টিভির সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। আসলে, মানুষ মাত্রই যতক্ষন শ্বাস ততক্ষণ আশ।

৪৩. যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে [সবই মহাভারতে পাওয়া যাবে]:- ভারতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এমনই যে গুণীজনেরা বলেন, যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে।

৪৪. যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা [শত্রুর সব কিছুই মন্দ]:- নিন্দুকেরা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রতিভা স্বীকার করতে চায় না। এমনকি, তারা কবিগুরুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও নানা কুকথা বলে থাকে। আসলে, যাকে দেখতে নারী তার চলন বাঁকাই হয়।

৪৫. যেমন বুনাে ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল [যােগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী]:- খোকনের মাকে পাড়ার সবাই ভয় করে। কিন্তু খোকন যাকে বিয়ে করে এনেছে সেই মেয়েটি আবার কাউকেই তোয়াক্কা করে না। পাড়ার সবাই বলাবলি করছে যে, যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল এসে জুটেছে।

৪৬. রথ দেখা কলা বেচা [উভয় উদ্দেশ্য সাধন]:- রঘুবাবুর ট্রাভেল এজেন্সি থেকে প্রতি বছরই পুরী নিয়ে যাওয়া হয়। রঘুবাবু ব্যবসায়ী হলেও ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ। তার রথ দেখা আর কলা বেচা- দুটোই হয়ে যায়।

৪৭. শাক দিয়ে মাছু ঢাকা [গােপন করার ব্যর্থ চেষ্টা]:- ছেলেটা একের পর এক কুকর্ম করে আর প্রতিবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকাবার চেষ্টা করে।

৪৮. শাঁখের করাত [যেতেও কাটে আসতেও কাটে]:- সুখময়ের স্বভাবটি শাঁখের করাতের মতো- যেতেও কাটে আসতেও কাটে।

৪৯. শিরে সংক্রান্তিু [আসন্ন বিপদ]:- এখন বিকেল হলে কাউকে আর মাঠে দেখা যায় না কারণ সবার শিরে সংক্রান্তি অবস্থা। আর কদিন বাদেই তো মাধ্যমিক শুরু হতে চলেছে।

৫০. হাতে মারে না ভাতে মারে [প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতি না, করে পরােক্ষভাবে ক্ষতি করা]:- বিদ্রোহী শ্রমিকদের মালিকপক্ষ হাতে মারে না, ভাতে মারে।

error: Content is protected !!