বাক্য ও বাক্য পরিবর্তন
সূচিপত্র
বাংলা ব্যাকরণ
মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। যখনই তার মনের মধ্যে কোনো নতুন ভাবের উদয় হয় সেই মুহূর্তে সে কতকগুলি উপযুক্ত শব্দ নির্বাচন করে, সেগুলি পরপর সাজিয়ে, বাক্য তৈরি করে মনের ভাব প্রকাশ করে। ভাষার বৃহত্তম একক হল বাক্য। বাক্যের মাধ্যমেই ভাষার প্রকাশ ঘটে।
বাক্যের সংজ্ঞা
পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুই বা তার বেশি পদ একত্র মিলিত হয়ে যদি একটি সম্পূর্ণ ও সঙ্গত অর্থ প্রকাশ করে তাকে বাক্য (Sentence) বলা হয়। এই সংজ্ঞাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাক্য হল একাধিক পদের বিন্যাস এবং বাক্যের উদ্দেশ্য হলো একটি সঙ্গত অর্থ প্রকাশ করা। এই প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়। অনেকেই বলে থাকেন যে, একটিমাত্র পদ দিয়ে বাক্য তৈরি করা সম্ভব। যেমন-
বাবা- তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?
শিশু- মাকে।
উপরের উদাহরণে শিশুটি যে কথা বলেছে সেখানে একটিমাত্র পদ রয়েছে- ‘মাকে’। এটি অবশ্যই একটি বাক্য। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, শিশুটি মুখে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেও শ্রোতা বাকি শব্দগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিতে পেরেছে- “আমি মাকে বেশি ভালবাসি”। কথোপকথন চলাকালীন এরকম প্রায়ই হয়ে থাকে। বক্তা একটা শব্দ উচ্চারণ করলেও বাকি শব্দগুলো উহ্য থেকে যায় এবং সেগুলো শ্রোতা বুঝে নিতে পারে। কিন্তু এবিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে বাক্য তৈরি করতে গেলে দুই বা ততোধিক শব্দ (বা, পদ) লাগবে।
[পুনঃকথন- বাক্যের উপাদান কখনো শব্দ কখনো বা পদ বলছি। এর কারণ পাঠক অবশ্যই অনুমান করতে পারছেন। এর আগের দুটি অধ্যায় যথা ‘পদ পরিচয়’ এবং ‘বিভক্তি ও অনুসর্গ’ অধ্যায়গুলোতে দেখানো হয়েছে যে, বিভক্তি যুক্ত শব্দ সমান পদ। শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত করে শব্দকে পদে পরিণত করতে হয়, তবেই বাক্যে ব্যবহার করা যায়।]
বাক্যে শব্দের অর্থ
বাক্যের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে দেখেছি যে বাক্যের প্রধান উদ্দেশ্য হলো অর্থ প্রকাশ করা। শব্দের এই অর্থ তিন প্রকার হয়। যথা-
১) অভিধা– শব্দের যে অর্থ ব্যাকরণ ও অভিধানসম্মত তাকেই বলা হয় অভিধা। যেমন- রামবাবু পেশায় একজন উকিল। আলোচ্য বাক্যে শব্দগুলির অভিধানগত যা অর্থ সেই অর্থই বাক্যে প্রকাশিত হয়েছে।
২) লক্ষণা– শব্দের আভিধানিক অর্থকে অতিক্রম করে যখন বিশেষ অর্থ প্রকাশিত হয় সেই অর্থকে বলে লক্ষণা। যেমন- রামবাবু গ্রামের মাথা। আলোচ্য বাক্যটিতে ‘মাথা’ শব্দটির অর্থ ‘মস্তক’ নয়, গ্রামের প্রধান ব্যক্তি বোঝাতেই ‘মাথা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৩) ব্যঞ্জনা– শব্দার্থ যখন অভিধা এবং লক্ষণাকে অতিক্রম করে কোন গ্রহ গূঢ় অর্থ প্রকাশ করে, তাকে ব্যঞ্জনা বলা হয়। অন্যভাবে বললে, শব্দের যে শক্তি শব্দের বা বাক্যের আভিধানিক অর্থকে অতিক্রম করে বক্তার অভিপ্রেত কোনো অন্তর্নিহিত তাৎপর্যময় অর্থকে তুলে ধরে তাকে ব্যঞ্জনা বলে। যেমন, “রামবাবু সমবায় সমিতি স্থাপন করে গ্রামের কুটিরশিল্পের মরা গাঙে জোয়ার এনেছেন”। ‘মরা গাঙে জোয়ার’ আনা বলতে ক্ষয়িষ্ণু কুটিরশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করাকে বোঝানো হয়েছে।
বাক্য নির্মাণের শর্ত
‘সাহিত্যদর্পণ’ রচয়িতা বিশ্বনাথ কবিরাজ বলেন “বাক্যাং স্যাদ্ যােগ্যতাকাক্ষাসক্তিযুক্ত পদোচ্চয়ঃ”। অর্থাৎ, যোগ্যতা, আকাঙ্খা ও আসত্তি- এই তিনটি হল বাক্য নির্মাণের শর্ত। অন্যভাবে বললে, যোগ্যতা, আকাঙ্খা ও আসত্তি- এই তিন প্রকার গুণ থাকলে তবেই তাকে বাক্য বলা হবে।
১) যোগ্যত্য [Compatibility]- বাক্য যে অর্থ প্রকাশ করতে চায় তা যেন বাস্তবতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়। বাক্যের এই বিশেষ গুণটিকে বলা হয় যোগ্যতা। যেমন, তাদের গোয়ালঘরে দুটো বাঘ বাঁধা আছে। কথাটি ব্যাকরণগত ভাবে ঠিক হলেও বাস্তবতা বর্জিত। গোয়ালঘরে গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি বাঁধা থাকতে পারে কিন্তু বাঘ বেঁধে রাখার ব্যাপারটা অবাস্তব, আর বাস্তবসম্মত নয় বলেই এটি বাক্য নয়।
তবে, অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে কোন বাক্যের অর্থ বাস্তবসম্মত মনে না হলেও গভীরভাবে অনুধাবন করলে বাক্যটির অন্তর্নিহিত অর্থ পরিস্ফুট হয়। নিচের বাক্যটি লক্ষণীয়- “তাদের গোয়ালঘরে দুটো বাঘ বাঁধা আছে। এমন রাক্ষুসে বলদ আমি জীবনে দেখিনি!” দ্বিতীয় বাক্যটি বলা হবার পরেই বোঝা যাচ্ছে প্রথম বাক্যে যাদের ‘বাঘ’ বলা হয়েছে সেগুলি আসলে দুটি বলদ। হয়তো সেগুলি খুব হৃষ্টপুষ্ট আর সকলকে গুঁতোতে যায়, সেইজন্য তাদেরকে বাঘ বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে দুটো বাক্যেরই যোগ্যতা রয়েছে এবং দুটিই বাক্য।
২) আকাঙ্খা [Expectancy]- বাক্যের কাজ সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা। কোনো বাক্য যদি সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করতে না পারে তবে শ্রোতার আকাঙ্খা পূরণ হয় না এবং সেটিকে বাক্য বলা চলে না। আকাঙ্খা হল বাক্যের সেই শর্ত যা বাক্যের অর্থকে সম্পূর্ণ করার নিশ্চয়তা দেয়। যেমন, “আমি সকালে..” বলে যদি আর কিছু না বলা হয় তবে শ্রোতার আকাঙ্খা পূরণ হয় না। যদি বলা হয় “আমি সকালে হাটতে যাই”- এবারে শ্রোতার আকাঙ্খা পূরণ হল এবং এটি যথার্থ বাক্য হল।
৩) আসত্তি [Proximity]- বাক্যে যথাযথ পদবিন্যাসের রীতিকে বলা হয় আসত্তি। বাক্যে একটির পর আরেকটি পদ বসে একটি অর্থবোধক পদক্রম সৃষ্টি হলে তবেই শ্রোতা বক্তার মনের ভাব বুঝতে পারে। পদগুলি উল্টোপাল্টা বসানো হলে বাক্যের উদ্দেশ্যে সিদ্ধ হয় না। যেমন- ‘পরের রবিবার রামের বাবা বাড়ি ফিরবেন’। এই বাক্যটিতে পদগুলি যথাযথভাবে বসেছে বলেই বক্তার মনের ভাব শ্রোতার কাছে বোধগম্য হবে। কিন্তু যদি বলা হত- ‘রামের রবিবার পরের বাবা বাড়ি ফিরবেন’- এই বাক্যটিতে একই পদ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু কোনো সঙ্গত অর্থ প্রকাশ করতে পারছে না। সুতরাং আসত্তি না থাকলে বাক্যটি কেবল পদসমষ্টি বলে গণ্য করা হবে, সেটিকে বাক্য বলা যাবে না।
বাক্যের প্রকারভেদ
গঠনগত দিক থেকে বাক্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
১) সরল বাক্য (Simple Sentence)- যে বাক্যে একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকে তাকে সরল বাক্য বলা হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, একটি সরলবাক্যে অনেকগুলি অসমাপিকা ক্রিয়া থাকতেই পারে কিন্তু সমাপিকা ক্রিয়া থাকবে একটি। যেমন-
১] রিতা বিদ্যালয় যাচ্ছে।
২] রহিম ফুটবল খেলছে।
৩] আয়েষা পাঁচপাতা বাংলা পড়ে দুপাতা ইংরেজি লিখে দশটি পাটিগণিতের অংক কষে এইমাত্র উঠে টিভি দেখতে গেল।
উপরের বাক্য তিনটি সরলবাক্যের উদাহরণ। প্রথম উদাহরণে সমাপিকা ক্রিয়া ‘যাচ্ছে’, দ্বিতীয় উদাহরণে সমাপিকা ক্রিয়া ‘খেলছে’, তৃতীয় উদাহরণে সমাপিকা ক্রিয়া ‘গেল’। কিন্তু তৃতীয় বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়াও অনেকগুলি অসমাপিকা ক্রিয়া রয়েছে। সেগুলি হল- পড়ে, লিখে, কষে এবং দেখতে। সরলবাক্যের সংজ্ঞাতেই বলা হয়েছে যে এই বাক্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকবে। সুতরাং যতগুলোই অসমাপিকা ক্রিয়া থাক, সমাপিকা ক্রিয়া যদি একটি থাকে তাহলে সেটিকে সরলবাক্য বলা হবে।
২) জটিল বাক্য (Complex Sentence)- একটি প্রধান উপবাক্য এবং এক বা একাধিক অপ্রধান উপবাক্য নিয়ে যে বাক্য গঠিত হয় তাকে জটিল বাক্য বলে। অন্যভাবে বললে, একটি বাক্যে দুই বা তার বেশি ক্ষুদ্র বাক্য (যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া থাকে) থাকলে তাদেরকে ব্যাকরণের ভাষায় উপবাক্য বলা হয় এবং এই উপবাক্যগুলি নিজ নিজ অর্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি যদি অন্যটির উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে বাক্যটিকে জটিল বাক্য বলা হয়। যেমন-
১] যে যায় সে তো আর ফেরে না।
২] যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
৩] যদি বিকেলে বৃষ্টি আসে তাহলে সব পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাবে।
৩) যৌগিক বাক্য (Compound Sentence)- দুই বা তার বেশি সরলবাক্য সংযোজক, বিয়োজক বা সংকোচক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হলে সেই বাক্যটিকে বলা হয় যৌগিক বাক্য। যেমন-
১] অসীম প্রথম হয়েছে এবং আকাশ দ্বিতীয় হয়েছে।
২] তুমি আনতে পারো নতুবা আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
৩] প্রথমা আজ স্কুলে আসেনি কিন্তু সে অসুস্থ নয়।
উপরের তিনটি উদাহরণের প্রত্যেকটিতে দুটি করে সরলবাক্য যথাক্রমে ‘এবং’, ‘নতুবা’, ‘কিন্তু’ অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়েছে।
এই তিন প্রকার বাক্য ছাড়াও অনেকে মিশ্র বাক্য নামক আরেক প্রকার বাক্যের কথা বলে থাকেন। কেউ কেউ আবার জটিল বাক্যকে মিশ্র বাক্য বলে থাকেন। আবার অনেকেই মিশ্র বাক্য বলে আলাদা কোনো শ্রেণীকরণ স্বীকার করেন না।
মিশ্র বাক্য (Compound-Complex)- জটিল এবং যৌগিক বাক্যের মিশ্রণকে মিশ্র বাক্য বলা হয়। অন্যভাবে বললে, যে বাক্যে জটিল বাক্য এবং যৌগিক বাক্য উভয়েরই লক্ষণ মিশ্রিত থাকে তাকে মিশ্র বাক্য বলে। মিশ্র বাক্য হলো দুই বা তার বেশি জটিল বাক্যের সমবায়। যেমন-
১] তুমি যদি আসো তবে আমি যাবো কিন্তু তুমি যদি না আসো তবে আমি যাবো না।
উপরের বাক্যটিতে দুটি জটিল বাক্য রয়েছে। সেগুলি হল- ‘তুমি যদি আসো তবে আমি যাবো’ এবং ‘তুমি যদি না আসো তবে আমি যাবো না’। এই দুই জটিল বাক্য ‘কিন্তু’ অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে একটি যৌগিক বাক্য গঠন করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাক্যটিতে দুটি জটিল বাক্য মিলিত হয়ে একটি যৌগিক বাক্য গঠন করেছে। বাক্যটিতে জটিল এবং যৌগিক উভয় প্রকার বাক্যেরই লক্ষণ রয়েছে। এইজন্য বাক্যটি মিশ্র বাক্য।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত
১] যে গেল সে আর এলো না কিন্তু আমাদের যাওয়াটা বন্ধ হল। (জটিল + সরল)
২] বাড়ির দেওয়ালে নতুন রং হল এবং বিয়েটাও সম্পন্ন হল কিন্তু যেহেতু নতুন বউয়ের গ্রামে থাকাটা পছন্দ নয় তাই সে দুদিন বাদেই স্বামীর হাত ধরে শহরে চলে গেল। (যৌগিক + জটিল)
৩] যখন দরকার তখন ঠিক চেয়ে নেবে কিন্তু যখন ফেরত দিতে হবে তখন তার দেখাই পাওয়া যাবে না। (জটিল + জটিল)
অর্থ অনুসারে বাক্যের শ্রেণি বিভাগ
অর্থ অনুসারে বাক্যের শ্রেণি বিভাগ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এক্ষেত্রে অনেক লেখক (ব্যাকরণ বইয়ের লেখক) সরাসরি ইংরেজি শ্রেণিকরণ মেনে বাংলা বাক্যের শ্রেণি বিভাগ করেছেন আবার অনেকে কিছু বাড়তি ভাগ যোগ করে বিষয়টিকে বাংলার সঙ্গে মানানসই করার চেষ্টা করেছেন এবং অনেকেই এই চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের মতাতম একপ্রকার জোর করে চাপিয়ে দিয়েছেন। এই কারণে বর্তমানে প্রচলিত স্কুল পাঠ্য ব্যাকরণ বইগুলি খুললে দেখা যাবে, একটি বইয়ে একেক রকম লেখা আছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই যে বর্তমানে ইংরেজি বাক্য চার ধরণের হয়। যথা-
১) Declarative (বিবৃতিমূলক)
২) Interrogative (প্রশ্নবোধক)
৩) Imperative (অনুজ্ঞাসূচক)
৪) Exclamatory (বিস্ময়বোধক)
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সে থেমে গেল। (বিবৃতিমূলক)
সে কি থেমে গেল? (প্রশ্নবোধক)
থামো। (অনুজ্ঞাসূচক)
সে কী করে থামতে পারে! (বিস্ময়বোধক)
কিন্তু বাংলা বাক্যের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিকরণ নিয়ে অনেক বেশি জটিলতা রয়েছে যার অনেকটাই লেখকসৃষ্ট। সাধারণভাবে, বক্তার মনের ভাব বা বক্তার উদ্দেশ্য (Purpose) অনুযায়ী বাক্যের অর্থগত শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। যেমন, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে প্রশ্নবোধক বাক্য হয়, হঠাৎ কোনো আবেগ প্রকাশ করলে আবেগসূচক বাক্য হয়। কিন্তু অর্থ অনুসারে ইংরেজি বাক্য চার প্রকার অথচ বাংলা বাক্য কারো মতে সাত প্রকার, কারো মতে আট বা নয় বা দশ প্রকার। এই পার্থক্যের কারণ হল কিছু স্বঘোষিত পন্ডিতের দ্বারা মনগড়া শ্রেণি বিভাগ। কিছু ব্যাকরণ বইয়ে তো আবেগসূচক বাক্য আর বিস্ময়সূচক বাক্যকে আলাদা করে দেখানো হয়েছে। যাইহোক, এবিষয়ে অধিক বিতর্কে যাচ্ছি না। এখন দেখে নেওয়া যাক অর্থভিত্তিক বাংলা বাক্যের শ্রেণি বিভাগ।
(১) নির্দেশক বাক্য (Indicative Sentence)- যে বাক্যে কোনো ঘটনা বা ভাবের বিবৃতি থাকে সেই বাক্যকে নির্দেশক বা নির্দেশাত্মক বাক্য বলে। এই প্রকার বাক্যকে বিবৃতিমূলক বাক্যও বলা হয়।
যেমন- ছেলেটা একদম পড়াশােনা করে না।
আমড়া গাছে আম হয় না।
অদিতি পড়াশোনায় খুব ভালো।
কোয়েল কাল কলকাতা যাবে।
বাক্যে যে ঘটনা বা ভাবের বিবৃতি থাকে তা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক- এই বিচারে নির্দেশক বাক্যকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) হ্যাঁ-বাচক বাক্য: যে বাক্যের দ্বারা কোনাে কিছু স্বীকার করা হয় বা মেনে নেওয়া হয় তাকে হ্যাঁ-বাচক বাক্য বলে। এই প্রকার বাক্যের অপর নাম সদর্থক বাক্য বা অস্ত্যর্থক বাক্য বা হ্যাঁ-বােধক বাক্য বা ইতিবাচক বাক্য।
যেমন- অমলেন্দুবাবু জীবনবিজ্ঞান পড়ান।
আমাদের প্রধানশিক্ষক মহাশয় ভালো মানুষ।
ট্রেন যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছালো।
(খ) না-বাচক বাক্য: যে বাক্যে কোনাে কিছু অস্বীকার বা নিষেধ করা হয়, তাকে না-বাচক বাক্য বলা হয়। না-বাচক বাক্যকে নঞর্থক বাক্য বা নাস্ত্যার্থক বাক্য বা না-বােধক বাক্য বা নেতিবাচক বাক্য বলে।
যেমন- আমাদের পথ নেই আর।
এ কলমে লেখা যায়না।
এখনো ছেলেটা বাড়ি ফেরেনি।
(২) প্রশ্নবোধক বাক্য (Interrogative Sentence)- যে বাক্যের দ্বারা কোনাে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় বা জানতে চাওয়া হয়, তাকে প্রশ্নবােধক বাক্য বা প্রশ্নাত্মক বাক্য বলে।
যেমন- ছেলেটা কেমন পড়াশোনা করছে?
আমড়া গাছে কি আম হয়?
অদিতির গানের গলা কেমন?
কোয়েল কাল কোথায় যাবে?
(৩) অনুজ্ঞাবাচক বাক্য (Imperative Sentence)- যে বাক্যের দ্বারা আদেশ, অনুরোধ, উপদেশ ইত্যাদি বোঝায় তাকে অনুজ্ঞাবাচক বাক্য বলে।
যেমন- দয়া করে চুপ করুন।
এখন মাঠে খেলতে যেও না।
বুড়ো মানুষের কথাটা শোনো।
আপনারা শান্ত হোন।
(৪) প্রার্থনাসূচক বা ইচ্ছাসূচক বাক্য (Optative Sentence)- যে বাক্যের দ্বারা বক্তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ পায় কিম্বা কোনাে কিছু প্রার্থনা করা বােঝায়, তাকে প্রার্থনাসূচক বা ইচ্ছাসূচক বাক্য বলে।
যেমন- ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
মানুষটা যেন দৃষ্টি ফিরে পায়।
আজ যেন বৃষ্টি না হয়।
সকলের কল্যাণ হোক।
(৫) বিস্ময়বােধক বা আবেগসূচক বাক্য (Exclamatory Sentence)- যে বাক্যের দ্বারা মনের আনন্দ, দুঃখ, ভয়, ঘৃণা, ক্রোধ প্রভৃতি আবেগ প্রকাশ করা হয়, তাকে বিস্ময়বােধক বা আবেগসূচক বাক্য বলে।
যেমন- আহা! কী দেখিলাম!
হায় রে পোড়া কপাল!
বাব্বা! কত উন্নতি করেছ!
হায় হায়! লোকটা অকালেই চলে গেল!
(৬) কার্যকারণাত্মক বা শর্তসাপেক্ষ বাক্য (Conditional Sentence)- যে বাক্যের দ্বারা কোনাে কারণ বা শর্ত প্রকাশ পায়, তাকে কার্যকারণাত্মক বা শর্তসাপেক্ষ বাক্য বলে।
যেমন- যতক্ষন শ্বাস ততক্ষণ আশ।
যদি ধোঁয়া দেখো বুঝবে আগুনও আছে।
পড়তে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়।
যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।
(৭) সন্দেহবাচক বাক্য বা সংশয়াত্মক বাক্য: যে বাক্যের দ্বারা বক্তার মনের সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশিত হয় তাকে সন্দেহ বাচক বাক্য বা সংশয়াত্মক বাক্য বলে।
যেমন- মরে গেছে হয়তো।
এই বুঝি পা পিছলে পড়ে গেলাম।
সময়ের কাটা যেন থেমে গেছে।
বোধহয় ও পারবে।
বাক্য পরিবর্তন
বাক্যের অর্থ অপরিবর্তিত রেখে এক প্রকার বাক্য থেকে আরেক প্রকার বাক্যে রূপান্তর করাই হল বাক্য পরিবর্তন। প্রথমে বাক্যের গঠনগত পরিবর্তন দেখে নেওয়া যাক।
– লোকটি দরিদ্র হলেও লোকটি সৎ। (সরল)
– যদিও লোকটি দরিদ্র তথাপি সে সৎ। (জটিল)
– লোকটি দরিদ্র কিন্তু লোকটি সৎ। (যৌগিক)
উপরের তিনটি বাক্যের অর্থ এক কিন্তু গঠন ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির। বাক্য পরিবর্তনের কয়েকটি সাধারণ নিয়ম রয়েছে। সেগুলি খুব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
গঠনগতভাবে বাক্যের পরিবর্তন করার সময় তিনটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে।
১) সরলবাক্যের একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে। অসমাপিকা ক্রিয়া যতখুশি থাকতে পারে বা নাও পারে কিন্তু সমাপিকা ক্রিয়া একটি থাকবে এবং একটিই থাকবে।
২) জটিল বাক্যে দুটি খন্ডবাক্য (Clause) থাকবে এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কটা এমন হবে যেন একটি আরেকটির উপর নির্ভরশীল। দুটি খন্ডবাক্য মানেই কিন্তু দুটো ক্রিয়াপদও থাকবে।
৩) যৌগিক বাক্যে দুটি স্বাধীন খন্ডবাক্য ও, এবং, কিন্তু ইত্যাদি অব্যয় দ্বারা যুক্ত থাকে। যৌগিক বাক্যেও দুটি ক্রিয়াপদ থাকে।
এবার আসি বাক্য পরিবর্তনের কথায়। সরল বাক্য থেকে জটিল বা যৌগিক বাক্য করতে হলে প্রথমেই বাক্যটিকে দুটি ছোটো বাক্যে ভাগ করে নিতে হবে। দেখতে হবে বাক্যটিতে কোন অসমাপিকা ক্রিয়া আছে কিনা। যদি অসমাপিকা ক্রিয়া থাকে, তবে কাজটা অনেক সহজ হবে। যেমন-
‘বাঘ দেখে গ্রামের লোক চলে গেল’- বাক্যটিতে একটি অসমাপিকা ক্রিয়া রয়েছে- ‘দেখে’। এই বাক্যটিকে দুটি ছোটো বাক্যে ভাগ করা যেতে পারে- ‘গ্রামের লোক বাঘ দেখলো’ এবং ‘তারা চলে গেল’। এবারে এই সরল বাক্যটিকে জটিল এবং যৌগিক বাক্যে রূপান্তর করা করা যাক-
জটিল বাক্যে রূপান্তর- জটিল বাক্যে দুটি বাক্যখন্ড যা, যে, যেটি, যেখানে, যখন, যখন-তখন, যেমন-তেমন ইত্যাদি পদ দিয়ে যুক্ত থাকে। উপরের উদাহরণে সরলবাক্যটিকে ভেঙে যেদুটি ছোটো বাক্য গিয়েছিল তাদেরকে জুড়ে দেওয়া যাক এইভাবে-
‘গ্রামের লোক যখনই বাঘ দেখলো, তখনই (তারা) চলে গেল’। অথবা বলতে পারি- ‘যেইমাত্র গ্রামের লোক বাঘ দেখলো, তখনই তারা চলে গেল।’ যেমন ভাবেই যোগ করা হোক, দেখতে হবে একটি বাক্যখণ্ডের উপর যেন অপরটি নির্ভরশীল হয়। তবেই সেটি জটিল বাক্য হবে।
যৌগিক বাক্যে রূপান্তর- যৌগিক বাক্যে রূপান্তর করতে হলে ছোটো বাক্যদুটিকে ‘এবং’, ‘ও’, ‘আর’ ইত্যাদি সংযোজক অব্যয় দিয়ে যোগ করে দিলেই হবে। যেমন- ‘গ্রামের লোক বাঘ দেখলো এবং চলে গেল’। কিংবা বলা যেতে পারে- ‘বাঘ দেখলো আর গ্রামের লোক চলে গেল।’ মোটকথা হল, দুটি বাক্যখন্ডের অর্থকে জুড়ে দিলেই যৌগিক বাক্য হয়।
এতক্ষণ ধরে সরল থেকে জটিল এবং যৌগিক বাক্যে রূপান্তর সম্পর্কে আলোচনা করা হল। জটিল এবং যৌগিক বাক্যকে সরল বাক্যে পরিণত করতে হলে ওই একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে, তবে উল্টো দিক থেকে। আগেই বলা হয়েছে যে, জটিল এবং যৌগিক বাক্যে দুটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে। সেই দুটি ক্রিয়াপদের একটিকে (সাধারণত, যে ক্রিয়াটি আগে ঘটে সেটিকে) অসমাপিকা ক্রিয়াতে পরিণত করতে হবে। যেমন-
জটিল- যখন বিকেল হয়, পাখিরা বাসায় ফেরে।
যৌগিক- বিকেল হয় এবং পাখিরা বাসায় ফেরে।
উপরের বাক্য দুটির একই অর্থ, শুধু গঠন আলাদা। প্রথমটি জটিল বাক্য এবং দ্বিতীয়টি যৌগিক বাক্য। দুটি বাক্যেই দুটি করে সমাপিকা ক্রিয়া রয়েছে- ‘হওয়া’ এবং ‘ফেরা’। প্রথমে বিকেল হচ্ছে এবং তারপর পাখিরা বাসায় ফিরছে। প্রথম ক্রিয়াটি ‘হওয়া’, এটিকে অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপ দিলেই সরলবাক্যে করা যাবে। যেমন-
‘বিকেল হলে পাখিরা বাসায় ফেরে।’ আবার, বাংলা ভাষায় অনেকসময় ‘হ’ ধাতুনিষ্পন্ন ক্রিয়াপদগুলি উহ্য থাকে, তাই ‘হলে’ ,ক্রিয়াপদটি না উল্লেখ করেও চলে। বলা যেতে পারে- ‘বিকেলে পাখিরা বাসায় ফেরে’। এটিও সরল বাক্য।
এবারে জটিল থেকে যৌগিক এবং যৌগিক থেকে জটিল বাক্যের রূপান্তর দেখে নেওয়া যাক। এই দুই প্রকার বাক্যেই দুটি খন্ডবাক্য থাকে। তার মানে, এদের রূপান্তর করা অনেকটা সহজ। বাক্যখন্ডগুলিকে ‘এবং’, ‘কিন্তু’ ইত্যাদি দিয়ে যোগ করলেই যৌগিক বাক্য; আর, ‘যা’, ‘যা-তা’, যখন-তখন ইত্যাদি অব্যয় দিয়ে যোগ করলে জটিল বাক্য হয়ে যায়। যেমন-
যখন মাঝরাত তখন শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল। (জটিল)
মাঝরাত হল এবং শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল। (যৌগিক)
আশা করি গঠনগতভাবে বাক্য পরিবর্তনের বিষয়টি বোঝা গেল। এবারে যত বেশি অভ্যাস করা হবে তত নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারা যাবে।