আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা|| Adhunik Bangla Sahitya Notes
পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রস্তুতি পর্ব বলে মনে করা হয়। উনবিংশ শতকের সূচনাপর্ব থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা। তার আগে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ছিল মূলত পদ্যনির্ভর। উনিশ শতকের শুরুতেই খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগে প্রথম বাংলা ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল। ইংরেজদের প্রচেষ্টায় এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষারও প্রচলন হয়েছিল। এসবের ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্যে নানান নতুন আঙ্গিকের জন্ম হয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
আলোচ্য পোস্টে একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় সেমিস্টারের পাঠ্য ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা’ অধ্যায় থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেওয়া হলো। যদিও এই অধ্যায় থেকে অনেকগুলি বড় প্রশ্ন হতে পারে; কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের বিভ্রান্ত না করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই তুলে ধরলাম।
প্রশ্ন: গীতিকবিতা কাকে বলে? এই ধারায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান আলোচনা করো। (২০১৫, ২০১৮, ২০২২)
উত্তর- গীতিকবিতা বলতে বোঝায় কাহিনী বর্জিত গীতিমূলক ছোট কবিতা। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে কবির ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন করা হলো গীতিকাব্যের উদ্দেশ্য। আবার রবীন্দ্রনাথ একটিমাত্র ভাবের সংগত প্রকাশের মাধ্যমে মধ্যে গীতিকাব্যের লক্ষণ দেখেছেন। কবিমনের একান্ত ভাবনা যে কবিতার মাধ্যমে ফুটে ওঠে তাকেই গীতিকবিতা বলা হয়।
বাংলা গীতিকবিতার স্রষ্টা হিসাবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ যোগ্য। তবে বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার মুল সুরটিকে ধরতে পেরেছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাকে ‘ভোরের পাখি’ বলে অভিহিত করা হয়।
কাব্য পরিচয়- বিহারীলালের উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল সংগীতশতক (১৮৬২), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গ সন্দর্শন (১৮৭০) বন্ধু বিয়োগ (১৮৭০), প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০) এবং সারদামঙ্গল (১৮৭৯) ও সাধের আসন (১৮৮৯)। কাব্যগুলির মধ্যে ‘সারদামঙ্গল’ হল বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ রচনা। তবে কাব্য হিসাবে ‘বঙ্গসুন্দরী’ ও ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঊনবিংশ শতকে বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ফলে নারী জাতি সম্পর্কে যে নতুন বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ কাব্যের বিষয় কবির সৌন্দর্যচেতনা।
বিহারীলালই প্রথম বাংলা কবি যিনি নিজের মনের রং দিয়ে জগতকে রঞ্জিত করে দেখেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিকবির মর্যাদা দিতে হয়। বিহারীলাল চক্রবর্তী সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। অবশ্য পরবর্তীকালের অনেক সমালোচক বিহারীলালের কবি প্রতিভা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। (শব্দসংখ্যা ১৮৫)
প্রশ্ন: বাংলা গদ্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো। (২০১৬, ২০১৮, ২০২০)
উত্তর: যদিও বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টীয় দশম শতকে কিন্তু খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যময়। কিছু চিঠিপত্রে এবং দলিল দস্তাবেজ বাংলা গদ্যের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। খ্রিষ্টান মিশনারীগণ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছু বাংলা গদ্য রচনা করেছিলেন। তবে বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম সার্থক শিল্পী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা সংস্কারক এবং সর্বোপরি একজন লেখক। বাংলা ভাষায় গদ্য সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি বেশ কিছু সাহিত্য অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলি হলো ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘বাংলার ইতিহাস’, ‘মহাভারতের উপক্রমণিকা’ প্রভৃতি।
বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘চরিতাবলী’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা রচনা করেছিলেন।
সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর লেখেন ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ প্রভৃতি গ্রন্থ।
ভাষা বিষয়ক বিদ্যাসাগরের একটি মৌলিক রচনা হল ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’। তার অন্যান্য রচনা গুলির মধ্যে যোগ্য হল উল্লেখযোগ্য হলো ‘রত্নপরীক্ষা’, ‘ব্রজবিলাস’ ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (অসমাপ্ত)।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী যার হাত ধরে বাংলা সাধু গদ্যের বিকাশ হয়েছিল। (শব্দসংখ্যা ১৭২)
প্রশ্ন: মাইকেল মধুসূদন দত্তের দুটি নাটকের নাম লেখা৷ নাট্যকার হিসাবে তার কৃতিত্ব আলোচনা করো। (২০১৭, ২০২৩)
উত্তর- মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা দুটি নাটক হল- শর্মিষ্ঠা এবং পদ্মাবতী।
বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের অভিনয় দেখতে গিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে যথার্থ নাটকের অভাব অনুভব করেছিলেন। সংস্কৃতানুগ বাংলা নাটকের মুক্তির জন্য তিনি নিজে নাটক রচনা করবেন মনস্থির করেন। বিষয়বস্তু আহরণের জন্য তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগার থেকে কয়েকটি সংস্কৃত ও বাংলা গ্রন্থ আনেন। তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯)। তারপর একে একে রচনা করেন ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০) ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) নাটক এবং দুটি প্রহসন- ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ (১৮৬০)।
নাট্যকার হিসেবে মধুসূদন দত্তের প্রধান কৃতিত্ব-
১) বাংলা নাটকে তিনিই প্রথম সংস্কৃত রীতি পরিহার করে ইউরোপীয় রীতি প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যসাহিত্য এর দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
২) তাঁর কৃষ্ণকুমারী নাটকটি প্রথম বাংলা ঐতিহাসিক ট্রাজেডি নাটক।
৩) নাট্যকার হিসেবে মধুসূদন দত্ত সমাজ এবং সমকালের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তাই দেখা যায়, তাঁর রচিত প্রহসন দুটিতে (‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’) সমকালীন সামাজিক অসঙ্গতির প্রতি চরম ব্যাঙ্গের আঘাত হানা হয়েছে। (শব্দসংখ্যা ১৫৭)
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থগুলির কাল অনুসারে বিভাগ করাে। প্রতি বিভাগের একটি করে কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো। (২০১৯)
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি কবিগুরু। কিশোর বয়সেই তাঁর কাব্য রচনার সূচনা ঘটে এবং আজীবন কাল তিনি কাব্য সাধনা করে গেছেন। সারাজীবন তিনি অজস্র কবিতা লিখেছেন। বর্তমান যুগের পাঠক তাঁর রচনা সম্ভার দেখে যেমন বিস্মিত হয় তেমনি মুগ্ধ হয় তাঁর রচনায় ভাবের বৈচিত্র্য দেখে। আসলে, কবি তাঁর জীবনের একেকটি পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবকে বাণীরূপ দিয়ে গেছেন। সেইজন্য তাঁর কোনো কোনো কবিতায় মর্ত্যপ্রীতি ফুটে উঠেছে, আবার কোনো কোনো কবিতা আধ্যাত্মচেতনায় উজ্জ্বল। যাইহোক, সাহিত্যের পণ্ডিতগণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসমূহকে আটটি পর্যায়ে (কেউ কেউ সাতটি পর্যায়ে) ভাগ করেছেন। সেগুলি হল-
১) সূচনাপর্বঃ এই পর্বে কবির রচনায় পূর্বজ কবিদের প্রভাব স্পষ্ট। উল্লেখযোগ্য কাব্য- কবিকাহিনী, ভগ্নহৃদয়, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী প্রভৃতি।
২) উন্মেষ পর্বঃ এই পর্ব থেকে কবির স্বকীয়তা লক্ষণীয়। উল্লেখযোগ্য কাব্য- সন্ধ্যাসঙ্গীত, প্রভাতসঙ্গীত, ছবি ও গান প্রভৃতি।
৩) ঐশ্বর্য পর্বঃ এই পর্বে কবি-প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য রচনা- মানসী, সোনার তরী প্রভৃতি।
৪) অন্তর্বর্তী পর্বঃ মর্ত্যপ্রীতি থেকে অধ্যাত্মচেতনায় উত্তরণের অন্তর্বর্তী পর্যায় এটি। নৈবেদ্য, খেয়া প্রভৃতি এই পর্বের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
৫) গীতাঞ্জলি পর্ব বা অধ্যাত্ম পর্বঃ এই পর্বের রচনাগুলি ভগবৎপ্রেমে স্নিগ্ধ। উল্লেখযোগ্য রচনা- গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি।
৬) বলাকা পর্বঃ এই পর্বের রচনাগুলিতে সংস্কারমুক্তি এবং গতির বাণী ধ্বনিত হয়েছে। বলাকা, পূরবী, মহুয়া প্রভৃতি এই পর্বের প্রধান রচনা।
৭) পুনশ্চ পর্বঃ এই পর্বে কবি গদ্যছন্দের সৃষ্টি এবং পরীক্ষায় মগ্ন। উল্লেখযোগ্য কাব্য- পুনশ্চ, শ্যামলী, পত্রপুট প্রভৃতি।
৮) অন্তিমপর্বঃ কবির জীবনের অন্তিম পর্বে রচিত হয়েছিল রোগশয্যায়, আরোগ্য প্রভৃতি কাব্যগুলি।
প্রশ্ন: ‘নীলদৰ্পণ’ নাটকের নাট্যকার কে? এটির ইংরেজি অনুবাদ কে করেছিলেন? নাটকটির প্রভাব উল্লেখ করাে। ১+১+৩ (২০২০)
উত্তরঃ নীলদর্পণ (১৮৬০) নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র।
নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম এবং প্রধান নাটকটি হল নীলদর্পণ। এই নাটকে সাধারণ মানুষদের ওপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের সার্থক প্রতিফলন ঘটেছিল। উল্লেখ্য যে, ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বাংলা জুড়ে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিদ্রোহ শুরু করেছিল, যা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে খ্যাত। এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটেই নীলদর্পণ নাটকটি রচিত হয়েছিল।
নাটকটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং জনমানসে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়, যারা নীল চাষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল না, তারাও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছিল।
নীলদর্পণ নাটকের প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলে ইংরেজরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই নাটকের প্রকাশক রেভাঃ জেমস লঙ-এর জেল ও জরিমানা হয়েছিল এবং এই নাটকে যারা অভিনয় করত তারাও রাজরোষের শিকার হত।
এই নাটকের ইংরেজি সংস্করণ (The Indigo Mirror) ইংল্যান্ডে প্রচারিত হলে সেখানকার নাগরিক সমাজে নীলকর সাহেবদের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ইন্ডিগো কমিশন বসিয়ে নীলচাষ সম্পর্কে সরেজমিনে তদন্ত শুরু হয়। (শব্দসীমা- ১৬৫)