বাংলা শব্দের উৎস বিচার
সূচিপত্র
ভাষার আসল সম্পদ হল শব্দ। যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যতখানি সমৃদ্ধ হয় সেই ভাষাকে ততখানি উন্নত বলে মনে করা হয়। আমাদের বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বাংলা শব্দভান্ডারের এই সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে ভারতীয় আর্য ভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে বহু বিবর্তনপথ বেয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। এইজন্য ভারতীয় আর্যভাষার (বৈদিক> সংস্কৃত) বহু শব্দ প্রত্যক্ষভাবে অথবা ক্রম বিবর্তনের পথ বেয়ে বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। পরবর্তীকালে যেসব বিদেশি জাতি ভারতে এসেছিল তাদের ভাষার থেকে প্রচুর শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারকে পূর্ণতর করেছে। এছাড়া, আর্য-পূর্ববর্তী প্রাচীন জনগোষ্ঠীর থেকেও কিছু শব্দ পাওয়া গেছে।
বর্তমানে বাংলা ভাষার ভান্ডারে রয়েছে প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ। তার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার শব্দ তৎসম (খাঁটি সংস্কৃত) শব্দ, আড়াই-তিন হাজার আরবি-ফারসি শব্দ, প্রায় চারশো তুর্কি শব্দ, হাজার দুয়েক ইংরেজি শব্দ এবং প্রায় পাঁচশাে পর্তুগিজ ও ফরাসি ইত্যাদি বিদেশি শব্দ। অবশিষ্টগুলি তদ্ভব ও দেশি শব্দ।
বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলি হল-
১) মৌলিক শব্দ– মৌলিক শব্দটির অর্থ নিজস্ব। বাংলা ভাষা হল ভারতীয় আর্যভাষার বংশধর। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে। সেই শব্দগুলিকে মৌলিক বাংলা শব্দ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাছাড়া, আর্যরা আমাদের দেশে আসার আগে যারা এখানে বসবাস করত, তাদের ভাষার কিছু শব্দ এখনো বাংলায় প্রচলিত রয়েছে। এই শব্দগুলিকেও মৌলিক বাংলা শব্দ বলা যেতে পারে।
২) আগন্তুক শব্দ– ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা থেকে এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশের ভাষা থেকে যেসকল শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে তাদেরকে আগন্তুক শব্দ বলা হয়।
৩) নবগঠিত শব্দ– ভাষা একটি সচল বিষয়। এই সচলতাই হল একটি ভাষার সজীবতার লক্ষণ। নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষাকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হতে হয়। কোনো ভাষা যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষকে নতুন শব্দের সন্ধান দিতে না পারে তবে সেই ভাষার অবলুপ্তির সম্ভাবনা থেকে যায়। আমাদের বাংলা ভাষা একটি সজীব ভাষা। নতুন যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলার শব্দভান্ডারও ক্রমশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। নতুন এই শব্দগুলিই নবগঠিত শব্দ।
মৌলিক বাংলা শব্দ
১. তৎসম শব্দ:- তৎসম কথার অর্থ তার সমান বা সংস্কৃতের সমান। যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে অবিকৃতভাবে বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে, তাদের বলা হয় তৎসম শব্দ। যেমন-
পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী, জনক, জননী, পিতামহ, মাতামহ, তৃণ, বৃক্ষ, লতা, নদী, সমুদ্র, কাষ্ঠ, হস্ত, পদ, স্কন্ধ, মস্তক, চক্ষু, কর্ণ, ব্যাঘ্র, সিংহ, হস্তী, চন্দ্র, সূৰ্য, দিবস, রজনী, সন্ধ্যা, আকাশ ইত্যাদি। এই সব শব্দই তৎসম শব্দ। বাংলায় প্রচলিত প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার শব্দই তৎসম শব্দ।
২. তদ্ভব শব্দ:- তদ্ভব কথার অর্থ হল সংস্কৃত (তার বা সংস্কৃত) থেকে জাত (ভাব)। যেসকল বাংলা শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাকৃত-অপভ্রংশ ইত্যাদি স্তরের মধ্য দিয়ে বাংলা শব্দভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের বলা হয় তদ্ভব শব্দ। যেমন-
হস্ত (তৎসম)> হত্থ (প্রাকৃত)> হাত, ভক্ত (তৎসম)> ভত্ত (প্রাকৃত)> ভাত, কাষ্ঠ (তৎসম)> কাটঠ (প্রাকৃত)> কাঠ ইত্যাদি। তেমনি কার্য> কাজ, কুম্ভকার> কুমার, কর্মকার> কুমার, দীপশলাকা> দিয়াশালাই, বধূ> বউ, মস্তক> মাথা, পদ> পা, পক্ষী> পাখি ইত্যাদি।
৩. অর্ধ-তৎসম বা ভগ্ন-তৎসম শব্দ:- যেসকল সংস্কৃত শব্দ ঈষৎ বিকৃত বা ভগ্ন অবস্থায় বাংলা শব্দভান্ডারে স্থানলাভ করেছে, তাদের বলা হয় অর্ধ-তৎসম বা ভগ্ন-তৎসম শব্দ। যেমন-
কৃষ্ণ> কেষ্ট, পুত্র> পুত্তুর, বিষ্ণু> বিষ্টু, বৈষ্ণব> বোষ্টম, শ্রাদ্ধ> ছেরাদ, শ্রীনাথ> ছিনাথ, শ্রী> ছিরি, বিশ্রী> বিচ্ছিরি, নিমন্ত্রণ>নেমন্তন্ন, প্রণাম> পেন্নাম, পুরোহিত> পুরুত, কায়স্থ> কায়েত, কুৎসিত> কুচ্ছিত, গৃহস্থ> গেরস্ত, গৃহিণী>গিন্নী, নিশ্চিন্ত>নিশ্চিন্দি, ঘৃণা>ঘেন্না, বৈদ্য>বদ্যি, স্বস্তি>সােয়াস্তি, মিত্র>মিত্তির, স্বাদ>সােয়াদ, অনাসৃষ্টি>অনাছিস্টি, বৃহষ্পতি>বেস্পতি, মিথ্যা>মিছা, গ্রাম>গেরাম, রাত্রি>রাত্তির, রৌদ্র>রোদ্দুর, জ্যোৎস্না> জোছনা, বৃষ্টি> বিষ্টি, মন্ত্র> মন্তর, তন্ত্র> তন্তর, যন্ত্র> যন্তর, মহােৎসব> মােচ্ছব, আধিক্যতা> আদিখ্যেতা ইত্যাদি।
৪. দেশী শব্দ:- বাংলা দেশে আর্যজাতির আগমনের আগে থেকেই যে জাতি বাস করতাে, তাদের ভাষার কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে। এই শব্দগুলিকে দেশী শব্দ বলা হয়।যেমন-
মুড়ি, ঢেঁকি, ঝাঁকা, খেয়া, ঝিঙ্গা, ঝাঁটা, খোঁপা, টোপর, খাঁচা, ছাল, ঢাল, পেট, ঢিল, ঝাড়ন, ঢোল, মাঠ, খড়, কুলা, কলা, লাঠি, তেঁতুল, বাদড়, গাড়ি, ঘােড়া, ঘোমটা, বঁটি, ডাঁসা, ডাব, বােঝা, দোয়েল, ফিঙে, কাতলা, চিংড়ি, চাঙা, ঢোঁড়া, ডিঙি, টান, ডাক, ঠেলা, ঠোকাঠুকি, কল, ঠেকো, ঘুম, ঠাট্টা, খাড়া, ঝুপঝাপ, হাল, রেত, টের, মিটমিট, দড়ি, দমকা, চুপ, ছপাছপ, কাত, ডাঙ্গা, আড়ষ্ট, মাঠ, কটা, ফাঁকা, ডালপালা, গােটা, চাহনি, ঢেঁকি, খেঁকশিয়ালী, চারা, হামাগুড়ি, ভাম, বাটনা-বাটা, ধড়, মােটা, খুঁটি, বােঝাই, গােঙানি, পােড়া, খুলি, ভিড়, পােকা, কেনাকাটা, ঝুলি ইত্যাদি।
আগন্তুক শব্দ
১. প্রাদেশিক শব্দ- ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিভিন্ন ভাষা থেকে যেসকল শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে তাদেরকে প্রাদেশিক শব্দ বলা হয়। যেমন-
হিন্দী শব্দ- ঝান্ডা, নয়া, কচুরি ইত্যাদি।
গুজরাটী শব্দ -তকলি, হরতাল, খাদি ইত্যাদি।
মারাঠী শব্দ- চৌথ, বর্গি ইত্যাদি।
তামিল শব্দ- চুরুট ইত্যাদি।
পাঞ্জাবি শব্দ- চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।
২. বিদেশি শব্দ– নানান সময়ে নানা উপলক্ষে বাংলাদেশে বহু বিদেশী জাতির সমাগম ঘটেছে। সেইসব জাতির ভাষাগুলি থেকে বহু শব্দ বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে থেকে যেসকল ভাষা বাংলা শব্দভান্ডারে প্রবেশ করেছে তাদের বিদেশি শব্দ বলা হয়।
বাংলায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের তালিকায় ইংরেজি, আরবি, ফারসি শব্দের সংখ্যাই সর্বাধিক। এই শব্দগুলি বাংলা ভাষার সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে এদের আর আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই।
আরবি– আইন, আদালত, দলিল, দালাল, হকুম, নমাজ, মেরামত, তারিখ, তাবিজ, কাগজ, কলম, দরখাস্ত, হিসাব, জাহাজ, তুফান, তামাসা, গােলাম ইত্যাদি।
ফারসী-আমির, উজীর, সিপাহ, মালিক, দোকান, খাতা, দোয়াত, গােলাপ, পর্দা, মশলা, শিশি, সিন্দুক, রুমাল, কারখানা, কারিগর ইত্যাদি।
ইংরেজী-চেয়ার, টেবিল, গ্লাস, অফিস, জেল, মাইল, সিনেমা, স্টেশন, কলেজ, স্কুল, বল, বেঞ্চ, পকেট, নিব, রেল, মোটর, ট্রাম, বাস, স্টিমার, হাসপাতাল, পুলিস, ডাক্তার ইত্যাদি।
ফরাসি—কাফে, কার্তুজ, কুপন, বিস্কুট, বুর্জোয়া, রেস্তোরাঁ, রেনেসাঁ ইত্যাদি।
পর্তুগিজ- আলমারি, আলপিন, কেরানী, গরাদ, জানালা, কামরা, পেয়ারা, নােনা, আতা, পেঁপে, কামিজ, ফিতা, বােতাম, আনারস, ইত্যাদি।
ওলন্দাজ– ইস্কাপন, রুইতন, হরতন, তুরুপ, ইস্ক্রুপ ইত্যাদি।
তুর্কি– আলখাল্লা, বেগম, বিবি, বাহাদুর, কুলি,
উর্দু ইত্যাদি।
চিনা—কাগজ, চা, চিনি, লিচু, লুচি ইত্যাদি।
জাপানী– রিকশা, হারিকিরি ইত্যাদি।
বর্মী– লুঙ্গি, ঘুঘনি ইত্যাদি।
রুশ শব্দ—বলশেভিক, সােভিয়েত, স্পুটনিক ইত্যাদি।
অস্ট্রেলীয় শব্দ—কাঙ্গারু ইত্যাদি।
তিব্বতী শব্দ—লামা ইত্যাদি।
বর্তমানে সমাজের সকল স্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত- অশিক্ষিত নির্বিশেষে বাঙালিদের মধ্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার যে কী পরিমাণ বেড়েছে তার একটি বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক-
ফেসবুক লাইভে এসে একটি মেয়ে বলছে- “হ্যালো বন্ধুরা, কে কে লাইভে আছো একটু কমেন্ট করো প্লিজ। আমার নেট কানেকশন একটু স্লো আছে তাই ভিডিওটা হেজি লাগতে পারে আর সাউন্ডটাও ক্লিয়ার নেই। হেডফোন ইউজ করছি তবু ডিস্টার্ব করছে। হ্যালো প্লিজ কমেন্ট করো, লাইক দিয়ে পাস করে যেও না।”
নবগঠিত শব্দসমূহ
মিশ্ৰ মিশ্র:- তৎসম, তদ্ভব, দেশী এবং বিদেশী শব্দের মধ্যে যেকোনো এক শ্রেণির শব্দের সঙ্গে অপর শ্রেণির শব্দ বা প্রত্যয় বা উপসর্গের সংযােগে গঠিত শব্দকে মিশ্র শব্দ বা সংকর শব্দ বলা হয়। যেমন-
হেডপন্ডিত [হেড (ইং)+পন্ডিত (তৎ)]
কাগজপত্র [কাগজ (চীন)+পত্র (তৎসম)],
সমনজারি [সমন (ইংরেজী)+জারি (ফারসি)],
গলিরাস্তা [গলি (তুর্কি)+রাস্তা (ফারসি)],
ধন-দৌলত [ধন (তৎসম)+দৌলত (আরবি)],
গাড়োয়ান-[গাড়ি (তদ্ভব)+ ওয়ান (হিন্দি)]
অনূদিত শব্দ:- বিদেশি শব্দের (বিশেষ করে ইংরেজি শব্দের) বাংলায় অনুবাদ করার ফলে যে নতুন শব্দগুলি বাংলা শব্দভাণ্ডারে সংযোজিত হয়েছে সেগুলিকে অনূদিত শব্দ বলা হয়। যেমন-
দুরদর্শন (টেলিভিসন), দূরভাষ (টেলিফোন), বৈদ্যুতিন চিঠি (ইমেইল), কালো-চিঠি (ব্ল্যাকমেইল), খোলা-বাজার (ওপেন মার্কেট), বহুতল (মাল্টিস্টোরিড), বহুধামাধ্যম (মাল্টিমিডিয়া) ইত্যাদি।
খণ্ডিত শব্দ:- উচ্চারণের সুবিধার জন্য কোনো কোনো বৃহৎ শব্দের অংশবিশেষ উক্ত শব্দের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হিসেবে বাংলা শব্দভান্ডারে স্থান পেয়েছে। এইসব সংক্ষিপ্ত শব্দগুলিকে খণ্ডিত শব্দ (ইংরেজিতে Clippings) বলা হয়। যেমন-
মাইক (মাইক্রোফোন), বাইক (বাইসাইকেল), ফ্রিজ (রেফ্রিজারেটর), প্লেন (এরোপ্লেন) ইত্যাদি।